সোমবার, ২১ মার্চ, ২০১৬

বিভীষিকাময় দক্ষিণ সুদান

স্বদেশসময়টোয়েন্টিফোর.কম
ছবি: সংগৃহীত
Decrease font Enlarge font
ঢাকা: মানবসভ্যতা যখন প্রতি মুহূর্তে উৎকর্ষের পথে ধাপে ধাপে এগিয়ে চলেছে, ঠিক তখনই যেন উত্তর-পূর্ব আফ্রিকার দেশ দক্ষিণ সুদানে মানবতা ভূলুণ্ঠিত হচ্ছে। রক্তে রঙিন হচ্ছে রাজপথ, ধর্ষিতার চিৎকারে ভারী হচ্ছে আকাশ। বেকারত্ব, ক্ষুধা আর দারিদ্র্য যেন দেশটির অসহায় মানুষগুলোকে প্রতি মুহূর্তে চিল-শকুনের মতো খুবলে খাচ্ছে।

ল্যান্ডলকড বা চারপাশে ভূমিবেষ্টিত দক্ষিণ সুদান ২০১১ সালের ৯ জুলাই সুদানের কাছ থেকে স্বাধীনতা লাভ করে। এর উত্তরে সুদান, পূর্বে ইথিওপিয়া, দক্ষিণ-পূর্বে কেনিয়া, দক্ষিণে উগান্ডা, দক্ষিণ-পশ্চিমে কঙ্গো আর পশ্চিমে সেন্ট্রাল আফ্রিকান রিপাবলিক।

হোয়াইট নাইলের প্রবাহের কারণে দেশটিতে বিশাল একটি জলা-বনভূমি রয়েছে, যা সুদ নামে পরিচিত। ২০১১ সালে জাতিসংঘে একটি সংস্কার প্রস্তাব গৃহীত হয়। ৯৮ দশমিক ৮৩ শতাংশ ভোটে এ প্রস্তাব পাস হয়। এরপর একই বছরের ৯ জুলাই স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে দক্ষিণ সুদান।

নবীনতম রাষ্ট্র হিসেবে পৃথিবীর মানচিত্রে ঠাঁই করে নিতেই দেশটি জাতিসংঘ, আফ্রিকান ইউনিয়ন, ইস্ট আফ্রিকান কমিউনিটি ও ইন্টারগভর্নমেন্টাল অথরিটি অন ডেভেলপমেন্টের সদস্যপদ লাভ করে।

কিন্তু স্বাধীনতা লাভের পরপরই দেশটির জনগণের নতুন করে বাঁচার স্বপ্ন যেন দুর্বিষহ হযে তাদের জীবনে হানা দেয়।

দক্ষিণ সুদানের ১০টি অঙ্গরাজ্যের নয়টিতেই শুরু থেকে সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ে বেশ কয়েকটি বিদ্রোহী সংগঠন। সংগঠনগুলোর দাবি, দেশটির সরকার অনির্দিষ্টকালের জন্য ক্ষমতায় টিকে থাকার পাঁয়তারা করছে। এ সংঘর্ষের ফলাফলে ভালো কিছু তো আসেইনি, উল্টো ঘরছাড়া হয়েছেন লাখ লাখ নিরীহ মানুষ। দিনে দিনে খারাপ থেকে খারাপতর হচ্ছে দেশটির অর্থনৈতিক ও সামাজিক পরিস্থিতি।

কোনো কোনো রাজনৈতিক বিশ্লেষক বলছেন, ‘ব্যর্থ রাষ্ট্রের দিকেই এগিয়ে যাচ্ছে দক্ষিণ সুদান।’

সর্বশেষ, যুক্তরাষ্ট্রের থিঙ্ক ট্যাংক, ফান্ড ফর পিস ও ফরেন পলিসি ম্যাগাজিনে প্রকাশিত বিশ্বের অস্থির রাষ্ট্রের তালিকায় শীর্ষে উঠে এসেছে দক্ষিণ সুদানের নাম।  ২০০৫ সাল থেকে প্রতি বছর এ তালিকা প্রকাশ করা হয়।

এদিকে, দেশটির সর্বশেষ পরিস্থিতি নিয়ে সম্প্রতি জাতিসংঘের মানবাধিকার সংস্থা ও অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল পৃথকভাবে দু’টি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। এতে ওই দেশের জনগণ নিয়ে বিশ্ববাসীর উদ্বেগ আরও ঘনীভূত হয়েছে।

প্রতিবেদনে বলা হয়, দক্ষিণ সুদানে যারাই সরকারের বিরোধিতা করছে, তাদেরকেই নানাভাবে হত্যা করছে সেনারা। এ হত্যার তালিকায় বাদ পড়ছে না শিশু ও অক্ষম মানুষেরাও। কাউকে প্রকাশ্য দিবালোকে জীবন্ত পোড়ানো হচ্ছে, কাউকে সর্বসমক্ষে গাছে ঝুলিয়ে ফাঁসি দেওয়া হচ্ছে, আবার কাউকে শিপিং কন্টেইনারে পুরে শ্বাসরোধ করে হত্যা করা হচ্ছে।

নির্যাতন শুধু এখানেই থেমে থাকেনি। সরকারপন্থী সেনারা রীতিমতো ধর্ষণ, লুণ্ঠন, অগ্নিসংযোগে মেতেছে। যার বাড়িতে খুশি হানা দিচ্ছে তারা। লুটে নিচ্ছে সবকিছু। ধর্ষণ করছে নারীদের। হত্যা করছে পুরুষ ও শিশুদের। এমনকি মিলিশিয়া বা সেনাবাহিনীর সদস্য এবং সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতনের পরিবর্তে নারীদের ধর্ষণের বৈধতা দিয়েছে দেশটির সরকার। যা এক চরম বিভীষিকাময় চিত্রের উৎকৃষ্ট উদাহরণ।

বর্তমানে দেশটির মানবাধিকার পরিস্থিতি বিশ্বের মধ্যে সবচেয়ে জঘন্য ও ভয়ঙ্কর উল্লেখ করে 'দেশটিতে কী হচ্ছে এসব?’ এমন প্রশ্নও তোলা হয়েছে জাতিসংঘের ওই প্রতিবেদনে। এতে জানানো হয়, সেনাদের সঙ্গে দেশটির সরকারের ‘যা খুশি করার’ একটা চুক্তি হয়েছে। যার ফলে এ চরম মানবিক বিপর্যয় দেখা দিয়েছে।

গত অক্টোবর মাস থেকে চলতি বছরের জানুয়ারি পর্যন্ত দেশটির পরিস্থিতি প্রতিবেদনে স্থান পেয়েছে। যেখানে খুন, ধর্ষণ, লুটপাট, জনগণের ওপর হামলা, সহিংসতাসহ সব ধরনের মানবতাবিরোধী কর্মকাণ্ডের জন্য দেশটির শাসক ও নীতি-নির্ধারকদেরই দায়ী করা হয়েছে।

২০১১ সাল থেকে অস্থিরতার সূচনা ঘটলেও ২০১৩ সালের ডিসেম্বর মাস থেকে তা তীব্র আকার ধারণ করে। দেশটির দুর্ভাগ্যের কারণ হিসেবে প্রেসিডেন্ট সালভা কিইর ও প্রাক্তন ভাইস প্রেসিডেন্ট রিক মাচারের মধ্যকার সম্পর্কচ্যুতিকেই উল্লেখ করা হয়েছে প্রতিবেদনে। এ সময়ে মধ্যে সেখানে বিভিন্ন সহিংসতার ঘটনায় ১০ হাজার মানুষ নিহত হয়েছেন। গৃহহীন হয়েছেন প্রায় ২৩ লাখ মানুষ।

মানুষে-মানুষে হানাহানি আর সরকার ও বিদ্রোহী গোষ্ঠীর মধ্যে সংঘর্ষে সেখানে টালমাটাল অবস্থা। এ পরিস্থিতিকে কেউ কেউ ‘গৃহযুদ্ধের’ সঙ্গে তুলনা করেছেন।

রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার কারণে সরকার বিদ্রোহীরা মাথাচাড়া দিয়েছে। আইন-আদালতের তোয়াক্কা না করে যে যার মতো জবর-দখল করে বেঁচে থাকার চেষ্টা করছে।

এদিকে, গত বছরের ডিসেম্বরে অনাবৃষ্টিতে দেশটিতে ভয়াবহ খাদ্য সংকট তৈরি হয়। দুর্ভিক্ষের দ্বারপ্রান্তে তখন প্রায় ৩০ হাজার মানুষকে মারাত্মক ক্ষুধা নিয়ে দিন অতিবাহিত করতে হয়। জাতিসংঘের আশ্রয় শিবিরে অবস্থান নেয় দেড় লাখেরও বেশি মানুষ। সেই ধকল এখনো কাটিয়ে উঠতে পারেনি জনগণ।

সংঘাত, অস্থিরতা, ক্ষুধা-দারিদ্র্য ও সহিংসতায় পদে পদে মৃত্যুর হাতছানি। মানুষের দিন যায়, রাত কাটে মৃত্যুর শঙ্কা বাড়ে। কিন্তু নবীন এই স্বাধীন রাষ্ট্রের শুভদিনের খোঁজ মেলে না..।

শেয়ার করুন

Author:

Etiam at libero iaculis, mollis justo non, blandit augue. Vestibulum sit amet sodales est, a lacinia ex. Suspendisse vel enim sagittis, volutpat sem eget, condimentum sem.

0 coment rios: