বিচারপতি নাঈমা হায়দার নেতৃত্বাধীন
হাই কোর্টের বৃহ্ত্তর বেঞ্চ সোমবার রুল নিষ্পত্তি করে এই রায় দেয়। বেঞ্চের অপর দুই
সদস্য হলেন- বিচারপতি কাজী রেজা-উল হক ও বিচারপতি মো. আশরাফুল কামাল।
রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম বহাল রাখার পক্ষে
রায় না এলে দেশ অচল করার হুমকি দিয়েছিল কওমি মাদ্রাসা ভিত্তিক সংগঠন হেফাজতে
ইসলাম। আর ওই রিট আবেদনকে ‘দেশকে ধর্মহীন
রাষ্ট্রে পরিণত করার চক্রান্ত’ আখ্যায়িত করে
জামায়াতে ইসলামী সোমবার সারাদেশে হরতাল করছে।
‘স্বৈরাচার ও সাম্প্রদায়িকতা
প্রতিরোধ কমিটির’ পক্ষে যে ১৫
বিশিষ্ট নাগরিক ১৯৮৮ সালে হাই কোর্টে এই রিট আবেদন করেছিলেন, তাদের অধিকাংশই মারা গেছেন।
ওই আবেদনের মূল বক্তব্য ছিল, একটি ধর্মকে ‘রাষ্ট্রধর্ম’ করার সিদ্ধান্ত
সংবিধান ও বাংলাদেশের অভিন্ন জাতীয় চরিত্রের সঙ্গে সাংঘর্ষিক।
অবশ্য ওই সাংবিধানিক আলোচনা পর্যন্ত
আদালতের শুনানি পৌঁছায়নি। ‘কমিটির’ রিট আবেদন করার ‘এখতিয়ার নেই’ জানিয়ে আদালত
আবেদনটি খারিজ করে দিয়েছে।
আদালতে রিট আবেদনের পক্ষে শুনানিতে
ছিলেন আইনজীবী সুব্রত চৌধুরী ও আইনজীবী
জগলুল হায়দার আফ্রিক। রাষ্ট্রপক্ষে ছিলেন অতিরিক্ত অ্যাটর্নি জেনারেল মুরাদ রেজা।
রায়ের পর সুব্রত চৌধুরী বিডিনিউজ
টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “পূর্ণাঙ্গ রায়
দেখব,
কেন খারিজ হয়েছে। এরপর আপিলের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেবে।”
অন্যদিকে মুরাদ রেজা বিডিনিউজ
টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “স্বৈরাচার ও
সাম্প্রদায়িকতা প্রতিরোধ কমিটির রিট আবেদন করার লোকাস স্ট্যান্ডাই (অধিকার বা এখতিয়ার) নেই বলে রিটটি খারিজ করেছে আদালত।
ফলে অষ্টম সংশোধনীতে সংবিধানে যুক্ত হওয়া
২ (ক) অনুচ্ছেদ বহাল থাকছে।”
২৮ বছর আগে রিটসামরিক শাসক হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের
শাসনকালে কার্যত বিরোধী দলবিহীন চতুর্থ জাতীয় সংসদে ১৯৮৮ সালের ৫ জুন সংবিধানের
অষ্টম সংশোধনী অনুমোদন হয়।
এর মাধ্যমে সংবিধানে অনুচ্ছেদ ২-এর
পর ২ (ক) যুক্ত হয়, যাতে বলা হয়, ‘প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রধর্ম হবে ইসলাম, তবে অন্যান্য ধর্মও প্রজাতন্ত্রে শান্তিতে পালন করা যাইবে’।
ধর্মনিরপেক্ষ দেশ হিসেবে ১৯৭১ সালে
যাত্রা শুরু করা বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় মূলনীতিতে এই পরিবর্তনের বৈধতা চ্যালেঞ্জ
করে তখনই ‘স্বৈরাচার ও সাম্প্রদায়িকতা
প্রতিরোধ কমিটির’ পক্ষে সাবেক
প্রধান বিচারপতি কামালউদ্দিন হোসেন, কবি সুফিয়া কামাল, অধ্যাপক সিরাজুল
ইসলাম চৌধুরীসহ ১৫ বিশিষ্ট নাগরিক হাই কোর্টে এই রিট আবেদন করেন।
তাদের আবেদনে বলা হয়, “বাংলাদেশে নানা ধর্মবিশ্বাসের মানুষ বাস করে। এটি সংবিধানের
মূল স্তম্ভে বলা হয়েছে। এখানে রাষ্ট্রধর্ম করে অন্যান্য ধর্মকে বাদ দেওয়া হয়েছে।
এটি বাংলাদেশের অভিন্ন জাতীয় চরিত্রের প্রতি ধ্বংসাত্মক।”
তার ২৩ বছর পর রিট আবেদনকারী পক্ষ
২০১১ সালের ৮ জুন একটি সম্পূরক আবেদন করে। তার প্রাথমিক শুনানি নিয়ে সেদিনই
বিচারপতি এ এইচ এম শামসুদ্দিন চৌধুরী ও বিচারপতি গোবিন্দ চন্দ্র ঠাকুরের তৎকালীন
হাই কোর্ট বেঞ্চ রুল দেয়।
সংবিধানের ওই সংশোধনীর মাধ্যমে ২
(ক) অন্তর্ভুক্তি কেন অসাংবিধানিক ও বেআইনি ঘোষণা করা হবে না, তা জানতে চাওয়া হয় রুলে।
জাতীয় সংসদের স্পিকার এবং আইন, বিচার ও সংসদবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সচিবকে রুলের জবাব দিতে বলা
হয়।
পঞ্চদশ সংশোধনী নিয়ে সম্পূরক আবেদন
২০১১ সালের ২৫ জুন আওয়ামী লীগ
ক্ষমতায় থাকা অবস্থায় পঞ্চদশ সংশোধনীতে সংবিধানের ওই ২ অনুচ্ছেদ আবারও সংশোধন করা
হয়।
প্রতিস্থাপিত ২ (এ) অনুচ্ছেদে বলা
হয়,
“প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম, তবে হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টানসহ অন্যান্য ধর্ম পালনে
রাষ্ট্র সমমর্যাদা ও সমঅধিকার নিশ্চিত করবে।”
পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে
তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বিলোপের পাশাপাশি বাহাত্তরের সংবিধানের মূলনীতি
ফিরিয়ে আনার দাবি করে আওয়ামী লীগ।
এরপর রিট আবেদনকারী পক্ষ পঞ্চদশ
সংশোধনীতে থাকা ওই বিধান চ্যালেঞ্জ করে সম্পূরক আবেদন করে।
শুনানি নিয়ে ২০১১ সালের ১ ডিসেম্বর
বিচারপতি এ এইচ এম শামসুদ্দিন চৌধুরী নেতৃত্বাধীন হাই কোর্টের দ্বৈত বেঞ্চ সম্পূরক
রুল দেয়।
পঞ্চদশ সংশোধনীতে আনা ২ (এ)
অন্তর্ভুক্তি কেন অসাংবিধানিক ঘোষণা করা হবে না- তা জানতে চাওয়া হয় রুলে।
প্রথম আবেদনের ২৩ বছর পর করা
সম্পূরক আবেদনে দেওয়া ওই দুটি রুল বৃহত্তর বেঞ্চে শুনানির জন্য গত বছর আবেদন করে
রিটকারী পক্ষ।
এর ধারাবাহিকতায় ২৯ ফেব্রুয়ারি
বিষয়টি শুনানির জন্য বৃহত্তর বেঞ্চের তালিকায় আসে। সেদিন আদালত ২৮ মার্চ শুনানির
দিন রাখে।
বাংলাদেশের সংবিধান
শুনানিতে যা হলোসোমবার বেলা সোয়া ২টায় শুনানির
শুরুতেই অতিরিক্ত অ্যাটর্নি জেনারেল মুরাদ রেজা বলেন, “পুরানো এই মামলাটি এসেছে। ১৯৮৮ সালে রিট আবেদনটি করা হয়।
সম্পূরক আবেদনে ২০১১ সালে রুল হয়। শুনানির জন্য আমাদের সময় দরকার।”
এ সময় আদালতে উপস্থিত সাবেক
বিচারপতি টিএইচ খান ও জ্যেষ্ঠ আইনজীবী এবিএম নুরুল ইসলাম এই রিট মামলায় বিবাদী
পক্ষে পক্ষভুক্ত হওয়ার আবেদন করতে দাঁড়ান।
নুরুল ইসলাম বলেন, “পক্ষভুক্ত হতে আবেদন নিয়ে এসেছি। পক্ষভুক্ত হতে অনুমতি
চাচ্ছি।”
আদালত এ সময় বলে, আগে রিট আবেদনকারীর আইনজীবীর বক্তব্য শুনে তারপর পক্ষভুক্ত
হওয়ার বিষয় বিবেচনা করা হবে।
এরপর রিট আবেদনকারীপক্ষের আইনজীবী
সুব্রত চৌধুরী দাঁড়ালে আদালত বলেন, “আপনাকে আমরা দেখে আসতে বলেছিলাম
‘স্বৈরাচার ও সাম্প্রদায়িকতা প্রতিরোধ কমিটির’ পক্ষে রিট করার লোকাস
স্ট্যান্ডাই (এখতিয়ার)
ছিল কি না?’
জবাবে সুব্রত চৌধুরী বলেন, ওই কমিটি ছাড়াও প্রত্যেকে আলাদা আলাদাভাবে আবেদনকারী
হয়েছিলেন।
আদালত বলেন, “আমরা দেখছি কমিটির পক্ষে রিট আবেদনটি করা হয়েছে।”
সুব্রত চৌধুরী বলেন, “শুনানির সময় আমরা বিস্তারিত বলব।”
এরপর আদালত বলেন, “কমিটির রিট আবেদন করার লোকাস স্ট্যান্ডাই নাই। রিট রিজেক্টেড, রুল ডিসচার্জড’।
আবেদনকারী
অধিকাংশই প্রয়াত
‘স্বৈরাচার ও
সাম্প্রদায়িকতা প্রতিরোধ কমিটির’ পক্ষে এই রিট
আবেদন করেছিলেন বিচারপতি কামালউদ্দিন হোসেন, বিচারপতি দেবেশ চন্দ্র ভট্টাচার্য, বিচারপতি
কে এম সোবহান, কবি সুফিয়া কামাল, অধ্যাপক খান সরওয়ার মুর্শিদ, ব্যারিস্টার সৈয়দ
ইশতিয়াক আহমেদ, অধ্যাপক কবীর চৌধুরী, শিল্পী কলিম শরাফী, অধ্যাপক মোশাররফ হোসেন,
সেক্টর কমান্ডার অবসরপ্রাপ্ত মেজর জেনারেল চিত্তরঞ্জন দত্ত,
অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী, রাজনৈতিক-কলামনিস্ট
বদরুদ্দীন উমর, সাংবাদিক ফয়েজ আহমদ, অধ্যাপক বোরহানউদ্দিন খান জাহাঙ্গীর ও অধ্যাপক আনিসুজ্জামান।
এদের মধ্যে সি আর দত্ত, বদরুদ্দীন উমর,
বোরহানউদ্দিন খান জাহাঙ্গীর, সিরাজুল
ইসলাম চৌধুরী ও অধ্যাপক আনিসুজ্জামান বেঁচে আছেন।
২০১১ সালে হাই কোর্ট এ মামলায় অ্যামিচি
কিউরি (আদালতের আইনি সহায়তাকারী) হিসেবে ১৪ জ্যেষ্ঠ আইনজীবীর নাম ঘোষণা করেছিল,
যাদের দুজন পরে মারা যান।
তারা হলেন- টি এইচ খান, কামাল হোসেন,
রফিক-উল হক, এম আমীর-উল ইসলাম, এম জহির, মাহমুদুল ইসলাম, এ এফ হাসান আরিফ,
রোকনউদ্দিন মাহমুদ, আখতার ইমাম, ফিদা এম কামাল, আজমালুল হোসেন কিউসি, আবদুল
মতিন খসরু,
ইউসুফ হোসেন হুমায়ুন, এ এফ এম মেসবাহ
উদ্দিন।
এদের মধ্যে এম জহির ও
মাহমুদুল ইসলাম মারা গেছেন।
0 coment rios: