তামাকজাত দ্রব্যকে মোড়কের আওতায় আনা ও আইন অনুযায়ী সতর্কবাণী প্রদানে বাধ্য করা, আইন লংঘনে শাস্তি নিশ্চিত করা, তামাকের মূল্য বৃদ্ধি এবং স্বাস্থ্য সতর্কীকরণ ছবি প্রদর্শণ তামাক নিয়ন্ত্রণের সহায়ক গ্রীন মাইন্ড সোসাইটি, নিরাপদ ডেভেলপমেন্ট ফাউন্ডেশন, স্বপ্নের সিড়ি সমাজ কল্যাণ সংস্থা, স্বদেশ মৃত্তিকা মানব উন্নয়ন সংস্থা, ফাস্ট ফোকাস ট্রাষ্ট, জনস্বার্থ ফাউন্ডেশন, এলআরবি ফাউন্ডেশন ও জাহাঙ্গীর ফাউন্ডেশন এর আয়োজনে রাজধানীর এসইএল সেন্টার মিলনায়তনে আজ শনিবার সকাল ১১ টায় বিশ্ব তামাকমুক্ত দিবস ২০১৬ উদযাপন উপলক্ষে মতবিনিময় সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভায় লিখিত বক্তব্য পাঠ করেন ফাস্ট ফোকাস ট্রাস্ট এর নির্বাহী এবং নিরাপদ ডেভেলপমেন্ট ফাউন্ডেশনের ভাইস প্রেসিডেন্ট এডভোকেট সুলতান মাহমুদ বান্না।
নিরাপদ ডেভেলপমেন্ট ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান ইবনুল সাঈদ রানার সভাপতিত্বে প্রধান অতিথি ছিলেন এলআরবি ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান অধ্যাপক আব্দুল কাদির পলাশ, অনুষ্ঠান সঞ্চালনা করেন গ্রীন মাইন্ড সোসাইটর সভাপতি জনাব আমির হাসান মাসুদ। বক্তব্য রাখেন স্বদেশ মৃত্তিকা মানব উন্নয়ন সংস্থার নির্বাহী হেলাল উদ্দিন আহমেদ, স্বপ্নের সিড়িঁ সমাজ কল্যান সংস্থার নিবার্হী উম্মে সালমা, জন স্বার্থ ফাউন্ডেশনের প্রেসিডেন্ট ডি.এম সাকলায়েন, এল আরবি‘ নির্বাহী সুলতানা রাজিয়া, ঢাকা ইন্টার ন্যাশনাল ইউনিভারসিটির সমন্বয়ক মো. মহি উদ্দিন, জাহাঙ্গীর ফাউন্ডেশনের নির্বাহী মো. আমানুল্লাহ নোমান, এসইএল এর নিরাপত্তা কর্মকর্তা আব্দুর রহমান, এনডিএফ এর সমন্বয়কারী আশরাফ সিদ্দিক শিশির, হাফেজ রবিউল ইসলাম, আনিস সিদ্দিক তুষার, ইঞ্জিনিয়ার মাসুদ রানা প্রমুখ।
বক্তারা বলেন, তামাক মানুষকে ক্রমশ মৃত্যুর দিকে ধাবিত করে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার গবেষণায় বলা হয়েছে, বিশ্বে প্রতি ৬ সেকেন্ডে একজন, প্রতিদিন ১৫ হাজারের অধিক এবং প্রতিবছর ৬০ লক্ষাধিক মানুষ তামাকজনিত রোগে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করে। তামাকজনিত মৃত্যুর এ ধারা কমিয়ে আনতে বিশ্ববাসী একজোট হয়ে প্রণয়ন করেছে ফ্রেমওয়ার্ক কনভেনশন অন টোব্যাকো কন্ট্রোল (এফসিটিসি), যা জনস্বাস্থ্য উন্নয়নে পৃথিবীতে প্রথম আন্তর্জাতিক চুক্তি হিসাবে স্বীকৃত। এফসিটিসির কয়েকটি ধারার আংশিক অনুসরণে সরকার ‘ধূমপান ও তামাকজাত দ্রব্য ব্যবহার (নিয়ন্ত্রণ) আইন ২০০৫’ পাস করে। ২০০৬ সালে এর বিধিমালা জারি করা হয়। ২০০৭ সালে বাংলাদেশ তামাক বিরোধী জোটের সুপারিশের প্রেক্ষিতে সরকার তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন বাস্তবায়নে জাতীয়, জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে টাস্কফোর্স গঠন করে। পাশাপাশি সারাদেশের তামাক নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রম সমন্বয়ের লক্ষ্যে স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের অধীন জাতীয় তামাক নিয়ন্ত্রণ সেল গঠন করে। বাংলাদেশে ২০০৯ সালে পরিচালিত গ্লোবাল এডাল্ট টোব্যাকো সার্ভে (গ্যাটস) অনুযায়ী, ৪৩.৩% (প্রায় সোয়া ৪ কোটি) মানুষ বিভিন্নরকম তামাক ব্যবহার করে। তামাকজনিত মৃত্যুর সংখ্যাও ক্রমবর্ধমান। বর্তমানে লক্ষাধিক মানুষ তামাকজনিত বিভিন্ন রোগে মারা যাচ্ছে। যেহেতু তামাক জনস্বাস্থ্যকে বিঘিœত করে, মানুষকে মৃত্যুর দিকে ধাবিত করে, তাই তামাকজাত দ্রব্যের মোড়কে বড় আকারে ছবিসহ স্বাস্থ্য সতর্কবাণী প্রদান, তামাকজাত দ্রব্যের সবরকম প্রচারণা নিষিদ্ধ, সব গণপরিবহন ও জনসমাগমস্থল ধূমপানমুক্ত করে তামাক নিয়ন্ত্রণ আইনের সংশোধনী পাস, তামাকজাত দ্রব্যের উপর উচ্চহারে কর আরোপের পাশাপাশি তামাকের উপর স্বতন্ত্র স্বাস্থ্যকর আরোপ করা দীর্ঘদিনের দাবি ছিল।
ধীরগতিতে হলেও সরকার ২০১৩ সালের ২৯ এপ্রিল আইনের সংশোধনী পাস করে। কিন্তু বিধিমালা পাস করতে দু’বছর বিলম্বিত হয়। অবশেষে ২০১৫ সালের ১৫ মার্চ সরকার বিধিমালা পাস করে। বিধিমালা অনুযায়ী আগামী মার্চ ২০১৬ এর মধ্যে বিড়ি-সিগারেটসহ সব তামাকজাত দ্রব্যের মোড়কে ছবিসহ সতর্কবাণী প্রদান করা হবে। ছবিসহ সতর্কবাণী প্রদানের ক্ষেত্রে আমরা পিছিয়ে পড়েছি। আমাদের পরে এফসিটিসি স্বাক্ষর এবং তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন করার পরও এ অঞ্চলের নেপাল, শ্রীলংকা, ভারত, পাকিস্তান আমাদের আগেই ছবিসহ সতর্কবাণী প্রদান করছে। এটা আমাদের জন্য হতাশাজনক। তবু এ সতর্কবাণী যেন সঠিকভাবে প্রদান করা যায়, সে প্রক্রিয়া এখনও শুরু করতে হবে।
তামাক কোম্পানিগুলো আইন লঙ্ঘন করে চলেছে। সর্বত্র তামাকজাত দ্রব্যের বিক্রয়স্থলে (পয়েন্ট অব সেল) বিজ্ঞাপন লক্ষ্য করা যাচ্ছে। রিপোর্টার্স ইউনিটির পাশেও সিগারেটের দোকানগুলোতে বিজ্ঞাপন রয়েছে, এগুলো আইন অনুযায়ী নিষিদ্ধ। তামাক কোম্পানিগুলো নিজেরাই আইন লঙ্ঘণ করছে না, ছোট ছোট দোকানদারদের বিজ্ঞাপন সরবরাহ করে আইন লঙ্ঘণে উৎসাহী করছে। যা রাষ্ট্রকে অশ্রদ্ধা প্রদর্শনের শামিল। কিন্তু অদৃশ্য কারণে তামাক কোম্পানিগুলো শাস্তির আওতায় আনা হয় না। মাঝেমধ্যে ভ্রাম্যমান আদালতের মাধ্যমে শুধু ছোট ছোট দোকানদারদের সাজা প্রদান করা হয়। সেটাও খুব বেশি নয়।
সমগ্র পৃথিবীতে তামাক নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রমকে জোরালো করতে ১৯৮৭ সালে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার উদ্যোগে অনুষ্ঠিত বিশ্ব স্বাস্থ্য সম্মেলনে প্রতিবছরের একটি দিনকে বিশ্ব তামাকমুক্ত দিবস হিসাবে উদযাপন করার সিদ্ধান্ত নিলেও ১৯৮৮ সালের বিশ্ব স্বাস্থ্য সম্মেলনে ৩১ মে তারিখকে প্রতিবছর বিশ্ব তামাকমুক্ত দিবস হিসাবে উদযাপন করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সদস্যভূক্ত দেশসমূহের প্রতিনিধিদের সর্বসম্মতিক্রমে গৃহিত সিদ্ধান্ত অনুযায়ী প্রতিবছর আলাদা আলাদা প্রতিপাদ্য বিষয়ে ৩১ মে সমগ্র পৃথিবীতে বিশ্ব তামাকমুক্ত দিবস হিসাবে উদযাপিত হয়ে আসছে।
দিবসটি সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগে প্রতিবছরই উদযাপিত হয়। বাংলাদেশ তামাক বিরোধী জোট ১৯৯৯ সালে প্রতিষ্ঠার পর থেকেই সারাদেশে জোটের সহযোগী সংগঠনগুলোর মাধ্যমে বিশ্ব তামাকমুক্ত উদযাপন করে আসছে। বাংলাদেশ তামাক বিরোধী জোটের সঙ্গে যুক্ত সংস্থাসমূহ এ বছরও দেশের ৬৪ জেলায়ই র্যালি, আলোচনা সভাসহ বিভিন্ন কর্মসূচির মাধ্যমে বিশ্ব তামাকমুক্ত দিবস উদযাপন করবে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্যে বলা হয়, পৃথিবীতে যত সিগারেট বিক্রয় হয়, তার ১০ভাগের এক ভাগ চোরাচালানের মাধ্যমে বিক্রি হলেও এর প্রভাব অনেক। সিগারেটের চোরাচালানের কারণে শুধু ইউরোপীয় ইউনিয়নভূক্ত তামাকের কর ১০ বিলিয়ন ইউরো থেকে বঞ্চিত হয়, যা বাংলাদেশি টাকায় ১ লক্ষ কোটি টাকারও বেশি। সিগারেট ও তামাকের চোরাচালান শুধু উন্নত দেশের সমস্যাই নয়, এটা দরিদ্র দেশের জন্যও একটি সমস্যা হিসাবে চিহ্নিত।
বাংলাদেশে যত কম দামে বিড়ি ও চর্বনযোগ্য তামাক পাওয়া যায়, পৃথিবীর কোন দেশেই এত কম দামে তামাক পাওয়া যায় না। তাই বিড়ি, গুল, জর্দার সর্বনি¤œ মূল্য ও কর বাড়াতে হবে। এগুলোও মোড়কের আওতায় আনতে হবে। কারণ, তামাকজাত দ্রব্যের মোড়কে স্বাস্থ্য সতর্কবাণী প্রদানের বাধ্যবাধকতা রয়েছে। স্থানীয় পর্যায়ে যেসব বিড়ি কারখানা, গুল কিংবা জর্দা কারখানা রয়েছে এসব প্রতিষ্ঠানকে কর ও আইনের আওতায় আনতে হবে। ২৫টি স্টিকের একটি প্যাকেটের উপর প্রত্যক্ষ কর কমপক্ষে ৭০% করা উচিত। এরপর মোট মূল্যের উপর ২% স্বাস্থ্য করসহ পরোক্ষ কর আরোপ করা যেতে পারে। তারপর এর খুচরা মূল্য নির্ধারণ হওয়া উচিত। দাম বৃদ্ধি পেলে দরিদ্র মানুষের মধ্যে মৃত্যুঘাতী নেশাদ্রব্যের ব্যবহার কমে আসবে।
অন্যদিকে সিগারেটের উপর বিভ্রান্তিমূলক ৪টি আলাদা বিভ্রান্তিমূলক কর স্তর বিদ্যমান। ফলে তামাক কোম্পানিগুলো প্রতারণা করে বেশি দামের সিগারেটকে কম দামের সিগারেট দেখিয়ে কর ফাঁকি দেয়। সিগারেটের সর্বনিম্ন মূল্য কমপক্ষে ৩৫টাকা করে তার উপর কর নির্ধারণ করতে হবে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে কমপক্ষে ৭০% কর বৃদ্ধি করা উচিত। উল্লেখিত পদ্ধতিতে মূল্য নির্ধারণ ও কর বাড়ানো হলে একদিকে সরকারের রাজস্ব আয় বাড়বে। পাশাপাশি তামাকের ব্যবহার ক্রমশ কমে আসবে। ফলে তামাকজনিত রোগ ও মৃত্যুহার কমবে।
তামাকমুক্ত দিবস উপলক্ষ্যে সুনির্দিষ্ট সুপারিশ ও দাবী:
- বিড়ি, সিগারেট, জর্দা, গুলসহ সবরকম তামাকের সর্বনি¤œ মূল্য নির্ধারণ
- বিড়ি, ছোট গুল এর কৌটা ও ছোট জর্দার প্যাকেটের সর্বনি¤œ মূল্য ১০ টাকা নির্ধারণ এবং সিগারেটের ক্ষেত্রে সর্বনিম্ন মূল্য ৩৫ টাকা নির্ধারণ, তারপর ৭০% কর প্রত্যক্ষ কর ও ২% স্বাস্থ্যকর নির্ধারণ
- সাদাপাতা বা খোলা তামাক পাতা বিক্রি নিষিদ্ধ করা
- সব তামাকজাত দ্রব্যকে মোড়কের আওতায় আনা ও আইন অনুযায়ী সতর্কবাণী প্রদানে বাধ্য করা। আইন লঙ্ঘণে শাস্তি নিশ্চিত করা।
- সিগারেটসহ তামাকজাত দ্রব্যের চোরাচালানের উৎস চিহ্নিত ও চোরকারবারীদের আটকসহ শাস্তি প্রদান
- সিগারেটসহ চোরাচালানকৃত তামাকজাত দ্রব্য প্রকাশ্য ধ্বংস করে তার সংবাদ গণমাধ্যমে প্রদান করা
- চোরাচালনকৃত সিগারেট ও অন্যান্য তামাকজাত দ্রব্য বিক্রি বন্ধে বিক্রয় কেন্দ্রগুলোতে অভিযান পরিচালনা। বিক্রেতার আটকের মাধ্যমে চোরাচালানকৃত সিগারেটের রুট চিহ্নিত করে শাস্তির আওতায় আনা।
- বাংলাদেশে বিক্রিত সব তামাকজাত দ্রব্যের মোড়কে আইন অনুযায়ী বাংলায় লিখিত স্বাস্থ্য সতর্কবাণী প্রদান নিশ্চিত করা
তামাকজাত দ্রব্যের উপর আরোপিত স্বাস্থ্যকর জনস্বাস্থ্য উন্নয়নে পরিকল্পিত উপায়ে ব্যয় নিশ্চিত করতে থাইল্যান্ডসহ অন্যান্য দেশের আলোকে হেলথ প্রমোশন ফাউন্ডেশন প্রতিষ্ঠা করা