গুলশনের রেস্তোরাঁ হোলি আর্টিজান বেকারিকে ঘিরে ফেলেছে সেনাবাহিনী। শনিবার ঢাকায়। ছবি: এএফপি।
উৎকণ্ঠার ১২ ঘণ্টার অবসান। সেনা কম্যান্ডোদের অভিযানে জঙ্গিদের দখলমুক্ত
হল বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকার গুলশনে কূটনৈতিক এলাকার জনপ্রিয় স্প্যানিশ
রেস্তোরাঁ হোলি আর্টিজান বেকারি। ভারতীয় সময় তখন সকাল পৌনে আটটা।
ঘণ্টাখানেক আগে দেওয়াল ভেঙে ঢোকা কম্যান্ডোরা ‘কাজ সেরে’ সামনের দরজা দিয়ে
বেরিয়ে আসামাত্র বাকিরা যখন উল্লাসে ফেটে পড়ছেন, তখনও কেউ জানেন না ঠিক কী
ঘটেছে। কী পরিণতি ভিতরে পণবন্দি হয়ে থাকা জনা ৩৫ দেশি-বিদেশি নাগরিকের। এর
ঘণ্টাখানেক পরে একটি অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জানালেন— অভিযান
সফল। ছয় হামলাকারীকে নিকেশ করে ১৩ পণবন্দিকে জীবিত উদ্ধার করা গিয়েছে। এদের
মধ্যে তিন জন বিদেশি। কিন্তু সকলকে উদ্ধার করা যায়নি। রেস্তোরাঁর মধ্যে
‘তারা’ যে ভাবে হত্যাকাণ্ড চালিয়েছে, তা চোখে দেখা যায় না! বিরোধী বিএনপি
নেত্রী খালেদা জিয়া এই ‘মানুষ খুনের ঘটনা’র নিন্দা করলেও এর জন্য দায়ী
করেছেন হাসিনা সরকারের ‘অপশাসন’কে।
হতাহতের প্রকৃত খবরটা আরও দু’ঘণ্টা পরে সাংবাদিক সম্মেলন করে জানালেন সামরিক অপারেশন দফতরের মুখপাত্র ব্রিগেডিয়ার জেনারেল নাইম আসফাক চৌধুরী। তাঁদের ‘অপারেশন থান্ডারবোল্ট’ সফল। কিন্তু তার আগেই রাতের অন্ধকারে জঙ্গিরা ২০ জন পণবন্দিকে হত্যা করেছে। প্রায় সকলকেই হত্যা করা হয়েছে কুপিয়ে ও গলা কেটে। এদের মধ্যে তিন জন বাংলাদেশি। বাকিরা সকলেই অন্য দেশের নাগরিক। নিহতদের মধ্যে রয়েছেন অষ্টাদশী ভারতীয় তারিশি জৈন। এ ছাড়া ৯ জন ইতালীয়, ৭ জন জাপানি এবং এক জন মার্কিন নাগরিক।
সেনা মুখপাত্রের এই ঘোষণার পরই সাফল্যের উচ্ছ্বাস চাপা পড়ে যায়। নানা প্রশ্ন উঠতে থাকে সামরিক অভিযান নিয়ে। কেউ কেউ বলেন, সকাল পর্যন্ত অপেক্ষা না-করে রাতেই অভিযান চালানো হলে হয়তো প্রাণ বাঁচানো যেত অনেক পণবন্দির। কিন্তু সেনা-মুখপাত্র কোনও প্রশ্নের জবাব দেননি।
শুক্রবার রাত পৌনে আটটা নাগাদ গুলশনের কূটনৈতিক এলাকার রেস্তোরাঁটিতে
জঙ্গি হানার খবর পাওয়া মাত্রই পুলিশ ঘিরে ফেলেছিল সেটি। কিন্তু যে ভাবে
পাল্টা আক্রমণ হতে থাকে, বোমার স্প্লিন্টার ও গুলিতে জখম হতে থাকেন একের
পর এক অফিসার— প্রমাদ গোনে পুলিশ। পরিস্থিতি খতিয়ে দেখতে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী
আসাদুজ্জামান খান কামাল বেশি রাতে পুলিশ ও র্যাব-কে (র্যাপিড অ্যাকশন
ব্যাটেলিয়ন) নিয়ে যখন বৈঠকে বসার তোড়জোড় করছেন, তত ক্ষণে বোমার ঘায়ে মারা
গিয়েছেন বনানী থানার ওসি সালাউদ্দিন আহমেদ ও সহকারী কমিশনার রবিউল ইসলাম।
পরপর বিস্ফোরণে কেঁপে উঠেছে রেস্তোরাঁটি। এলোপাথাড়ি ছুটে আসছে স্বয়ংক্রিয়
রাইফেলের গুলি। সেই বৈঠকেই গোয়েন্দারা পরামর্শ দেন, পরিস্থিতি হাতের বাইরে
যাওয়া আটকাতে দ্রুত সেনাবাহিনী ডাকা হোক।
সেনাদের আসতে যেটুকু সময় লাগে, সেই সময়টা জঙ্গিদের ব্যস্ত রাখতে ঘটনাস্থলে এসে পৌঁছন র্যাব-এর প্রধান বেনজির আহমেদ। টেলিভিশনে ঘটনার সরাসরি সম্প্রচার বন্ধ করে তিনি জঙ্গিদের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা শুরু করেন। তাদের কী দাবি জানতে চান। জবাবে তিন-চার বার বুলেট ছুটে আসার পরে, হঠাৎই উড়ে আসে ভুল বানানে ভরা একটি বার্তা— আমাদের তিনটি দাবি মানতে হবে।
এক, মাদারিপুরে কলেজ শিক্ষক রিপন চক্রবর্তীর ওপর হামলার দায়ে শুক্রবারই ঢাকা থেকে গ্রেফতার করা জেএমবি (জামাতুল মুজাহিদিন) নেতা খালিদ সাইফুল্লাকে মুক্তি দিতে হবে। দুই, রেস্তোরাঁ থেকে তাদের নিরাপদে ফিরে যেতে দিতে হবে। এবং তিন, এই হানাদারিকে ইসলাম প্রতিষ্ঠার স্বার্থে অভিযান হিসেবে স্বীকৃতি দিতে হবে।
ইতিমধ্যে চট্টগ্রামের ঘাঁটি থেকে বিমানবাহিনীর কয়েকটি বিমান সিলেট রওনা হয়েছে। মার্কিন নেভি সিলের কাছে প্রশিক্ষণ নেওয়া নৌবাহিনীর বিশেষ কম্যান্ডোদের ঘাঁটি সিলেটে। তাদের তৈরি থাকার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে আগেই। রাতের অন্ধকারে কম্যান্ডোরা নামে ঢাকা ক্যান্টনমেন্টের ছোট্ট এয়ার স্ট্রিপটিতে। সাভার থেকে এসে গিয়েছিল সেনাবাহিনীর বিশেষ বাহিনী সোয়াট।
সেনাপ্রধান, তিন বাহিনীর প্রধান, পুলিশের সর্বোচ্চ তিন কর্তা ও গোয়েন্দা বাহিনীর অধিনায়কদের ডেকে নিজের বাড়ি ‘গণভবন’-এ ওয়ার রুম খোলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। রাত গেল পরিস্থিতির পর্যালোচনায়। প্রাণহানির আশঙ্কার কথা মনে করিয়ে দিলেন এক গোয়েন্দা কর্তা। মস্কোর থিয়েটার হলের উদাহরণ তুলে ধরে তিনি বলেন— কম্যান্ডো অভিযানে সেখানে জঙ্গিদের নিকেশ করা গিয়েছিল বটে, কিন্তু কয়েকশো পণবন্দিকেও মরতে হয়। শেষ রাতে অবশ্য অভিযানের সিদ্ধান্তই নিলেন প্রধানমন্ত্রী। কারণ জঙ্গিদের একটি দাবিও মানা সম্ভব নয়। কম্যান্ডো প্রধানদের সঙ্গে বসে ‘অপারেশন থান্ডারবোল্ট’-এর খুঁটিনাটি ঝালিয়ে নিলেন সেনাকর্তারা।
ঘড়িতে তখন সকাল পৌনে সাতটা। আশপাশের বাড়িঘরের ছাদে মোতায়েন দূরপাল্লার রাইফেল হাতে স্নাইপারের দল। কম্যান্ডোদের নিয়ে দুটি জংলা রঙা সাঁজোয়া গাড়ি পাঁচিল ভেঙে পার্কিং করা দু’টো গাড়িকে চুরমার করে পৌঁছে গেল রেস্তোরাঁর পেছনের দেওয়ালের কাছে। ঝাঁকে ঝাঁকে উড়ে এল বুলেট। প্রচণ্ড শব্দে বিস্ফোরণ হল একটা। সাঁজোয়া গাড়ি একটু থেমে আরও জোরে দৌড়ে ধসিয়ে দিল রেস্তোরাঁর দেওয়াল। পিল পিল করে ঢুকে গেলেন প্রশিক্ষিত কম্যান্ডোরা। জঙ্গিদের নিকেশ করে রেস্তোরাঁর দখল নিতে সময় লাগল ঠিক ১৩ মিনিট। তার পরে চলল বিস্ফোরক খুঁজে বার করে নিষ্ক্রিয় করার কাজ, পরিভাষায় যাকে বলে ‘স্যানিটাইজ’ করা। মিলল প্রচুর শক্তিশালী আইইডি। জখম এক জঙ্গিকে ধরাও গেল। তার পরে কম্যান্ডোরা বেরিয়ে এলেন বাইরে। তাঁদের অভিনন্দন জানালেন বাকিরা। দমকল বাহিনী ততক্ষণে নেমে গিয়েছে আগুন নেভাতে। কিন্তু ভেতরে ঢুকেই স্তব্ধ সকলে। পাশাপাশি পড়ে গোটা কুড়ি দেহ। গলা কেটে খুন করা হয়েছে তাঁদের। রক্তের স্রোত মাড়িয়ে বার করে আনা হল জীবিত ১৩ জনকে।
অভিযান সফল, কিন্তু আনন্দ তখন উবে গিয়েছে সকলের। দু’দিনের জাতীয় শোক ঘোষণা করেছে বাংলাদেশ সরকার।
হতাহতের প্রকৃত খবরটা আরও দু’ঘণ্টা পরে সাংবাদিক সম্মেলন করে জানালেন সামরিক অপারেশন দফতরের মুখপাত্র ব্রিগেডিয়ার জেনারেল নাইম আসফাক চৌধুরী। তাঁদের ‘অপারেশন থান্ডারবোল্ট’ সফল। কিন্তু তার আগেই রাতের অন্ধকারে জঙ্গিরা ২০ জন পণবন্দিকে হত্যা করেছে। প্রায় সকলকেই হত্যা করা হয়েছে কুপিয়ে ও গলা কেটে। এদের মধ্যে তিন জন বাংলাদেশি। বাকিরা সকলেই অন্য দেশের নাগরিক। নিহতদের মধ্যে রয়েছেন অষ্টাদশী ভারতীয় তারিশি জৈন। এ ছাড়া ৯ জন ইতালীয়, ৭ জন জাপানি এবং এক জন মার্কিন নাগরিক।
সেনা মুখপাত্রের এই ঘোষণার পরই সাফল্যের উচ্ছ্বাস চাপা পড়ে যায়। নানা প্রশ্ন উঠতে থাকে সামরিক অভিযান নিয়ে। কেউ কেউ বলেন, সকাল পর্যন্ত অপেক্ষা না-করে রাতেই অভিযান চালানো হলে হয়তো প্রাণ বাঁচানো যেত অনেক পণবন্দির। কিন্তু সেনা-মুখপাত্র কোনও প্রশ্নের জবাব দেননি।
সেনাদের আসতে যেটুকু সময় লাগে, সেই সময়টা জঙ্গিদের ব্যস্ত রাখতে ঘটনাস্থলে এসে পৌঁছন র্যাব-এর প্রধান বেনজির আহমেদ। টেলিভিশনে ঘটনার সরাসরি সম্প্রচার বন্ধ করে তিনি জঙ্গিদের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা শুরু করেন। তাদের কী দাবি জানতে চান। জবাবে তিন-চার বার বুলেট ছুটে আসার পরে, হঠাৎই উড়ে আসে ভুল বানানে ভরা একটি বার্তা— আমাদের তিনটি দাবি মানতে হবে।
এক, মাদারিপুরে কলেজ শিক্ষক রিপন চক্রবর্তীর ওপর হামলার দায়ে শুক্রবারই ঢাকা থেকে গ্রেফতার করা জেএমবি (জামাতুল মুজাহিদিন) নেতা খালিদ সাইফুল্লাকে মুক্তি দিতে হবে। দুই, রেস্তোরাঁ থেকে তাদের নিরাপদে ফিরে যেতে দিতে হবে। এবং তিন, এই হানাদারিকে ইসলাম প্রতিষ্ঠার স্বার্থে অভিযান হিসেবে স্বীকৃতি দিতে হবে।
ইতিমধ্যে চট্টগ্রামের ঘাঁটি থেকে বিমানবাহিনীর কয়েকটি বিমান সিলেট রওনা হয়েছে। মার্কিন নেভি সিলের কাছে প্রশিক্ষণ নেওয়া নৌবাহিনীর বিশেষ কম্যান্ডোদের ঘাঁটি সিলেটে। তাদের তৈরি থাকার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে আগেই। রাতের অন্ধকারে কম্যান্ডোরা নামে ঢাকা ক্যান্টনমেন্টের ছোট্ট এয়ার স্ট্রিপটিতে। সাভার থেকে এসে গিয়েছিল সেনাবাহিনীর বিশেষ বাহিনী সোয়াট।
সেনাপ্রধান, তিন বাহিনীর প্রধান, পুলিশের সর্বোচ্চ তিন কর্তা ও গোয়েন্দা বাহিনীর অধিনায়কদের ডেকে নিজের বাড়ি ‘গণভবন’-এ ওয়ার রুম খোলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। রাত গেল পরিস্থিতির পর্যালোচনায়। প্রাণহানির আশঙ্কার কথা মনে করিয়ে দিলেন এক গোয়েন্দা কর্তা। মস্কোর থিয়েটার হলের উদাহরণ তুলে ধরে তিনি বলেন— কম্যান্ডো অভিযানে সেখানে জঙ্গিদের নিকেশ করা গিয়েছিল বটে, কিন্তু কয়েকশো পণবন্দিকেও মরতে হয়। শেষ রাতে অবশ্য অভিযানের সিদ্ধান্তই নিলেন প্রধানমন্ত্রী। কারণ জঙ্গিদের একটি দাবিও মানা সম্ভব নয়। কম্যান্ডো প্রধানদের সঙ্গে বসে ‘অপারেশন থান্ডারবোল্ট’-এর খুঁটিনাটি ঝালিয়ে নিলেন সেনাকর্তারা।
ঘড়িতে তখন সকাল পৌনে সাতটা। আশপাশের বাড়িঘরের ছাদে মোতায়েন দূরপাল্লার রাইফেল হাতে স্নাইপারের দল। কম্যান্ডোদের নিয়ে দুটি জংলা রঙা সাঁজোয়া গাড়ি পাঁচিল ভেঙে পার্কিং করা দু’টো গাড়িকে চুরমার করে পৌঁছে গেল রেস্তোরাঁর পেছনের দেওয়ালের কাছে। ঝাঁকে ঝাঁকে উড়ে এল বুলেট। প্রচণ্ড শব্দে বিস্ফোরণ হল একটা। সাঁজোয়া গাড়ি একটু থেমে আরও জোরে দৌড়ে ধসিয়ে দিল রেস্তোরাঁর দেওয়াল। পিল পিল করে ঢুকে গেলেন প্রশিক্ষিত কম্যান্ডোরা। জঙ্গিদের নিকেশ করে রেস্তোরাঁর দখল নিতে সময় লাগল ঠিক ১৩ মিনিট। তার পরে চলল বিস্ফোরক খুঁজে বার করে নিষ্ক্রিয় করার কাজ, পরিভাষায় যাকে বলে ‘স্যানিটাইজ’ করা। মিলল প্রচুর শক্তিশালী আইইডি। জখম এক জঙ্গিকে ধরাও গেল। তার পরে কম্যান্ডোরা বেরিয়ে এলেন বাইরে। তাঁদের অভিনন্দন জানালেন বাকিরা। দমকল বাহিনী ততক্ষণে নেমে গিয়েছে আগুন নেভাতে। কিন্তু ভেতরে ঢুকেই স্তব্ধ সকলে। পাশাপাশি পড়ে গোটা কুড়ি দেহ। গলা কেটে খুন করা হয়েছে তাঁদের। রক্তের স্রোত মাড়িয়ে বার করে আনা হল জীবিত ১৩ জনকে।
অভিযান সফল, কিন্তু আনন্দ তখন উবে গিয়েছে সকলের। দু’দিনের জাতীয় শোক ঘোষণা করেছে বাংলাদেশ সরকার।
0 coment rios: