বুধবার, ২৪ আগস্ট, ২০১৬

রামপাল বিদ্যুৎ প্রকল্প বাতিলের দাবি খালেদার

স্বদেশসময় টোয়েন্টিফোর ডটকম:

রামপাল বিদ্যুৎ প্রকল্প বাতিলের দাবি খালেদার
সুন্দরবনের অদূরে রামপালে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ প্রকল্পকে ‘দেশ ও গণবিরোধী’ অভিহিত করে এই প্রকল্প বাতিল করতে সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া।
তিনি বলেছেন, ‘বিদ্যুৎ উৎপাদনের অনেক বিকল্প আছে, বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের স্থানেরও অনেক বিকল্প আছে; কিন্তু সুন্দরবনের কোনো বিকল্প নেই।
“কাজেই সুন্দরবনকে নিশ্চিত ধ্বংসের মুখে ঠেলে দেওয়ার হঠকারী, অযৌক্তিক ও অলাভজনক রামপালের সকল কয়লা-বিদ্যুৎ প্রকল্প বাতিল করার জন্য আমরা সরকারের প্রতি দাবি জানাচ্ছি। আমি এই দাবির পক্ষে সোচ্চার হওয়ার জন্য ২০ দলীয় জোটের পক্ষ থেকে দেশবাসীর প্রতি আহ্বান জানাচ্ছি”, বলেন বিএনপি নেত্রী।
বুধবার বিকেলে রাজধানীর গুলশানে বিএনপি নেত্রীর রাজনৈতিক কার্যালয়ে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে শুধু রামপাল বিদ্যুৎ প্রকল্প নিয়ে কথা বলেন তিনি।
খালেদা জিয়া বলেন, ‘দেশের উন্নয়ন ও জনজীবনের স্বাচ্ছন্দের জন্য বিদ্যুৎ প্রয়োজন। কিন্তু সেই বিদ্যুৎ উৎপাদন  করতে গিয়ে যদি দেশ এবং দেশের স্বার্থ ক্ষতিগ্রস্ত হয়, জনজীবন বিপর্যস্থ হয়, পরিবেশ ও জীববৈচিত্র ধ্বংস হয়; তাহলে সেই সিদ্ধান্ত হয় দেশবিরোধী-গণবিরোধী। বাগেরহাট জেলার রামপালে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপন ঠিক তেমনি একটি দেশবিরোধী-গণবিরোধী সিদ্ধান্ত।’

তিনি বলেন, বিশ্বের বৃহত্তম ম্যানগ্রোভ বনাঞ্চল সুন্দরবনের মাত্র ১৪ কিলোমিটার দূরে রামপালে ১৩২০ মেগাওয়াট এবং মাত্র ১০ কিলোমিটার দূরে ৫৬৫ মেগাওয়াট ওরিয়ন কয়লা বিদ্যুৎকেন্দ্র প্রতিষ্ঠার কাজ এগিয়ে চলেছে। দেশ-বিদেশের পরিবেশবিদ, সামাজিক সংগঠন এবং গবেষণা প্রতিষ্ঠানসমূহের প্রতিবাদ এবং বিশ্বের বিভিন্ন স্থানে এ ধরনের প্রকল্পের মারাত্মক বিরূপ প্রতিক্রিয়ার দৃষ্টান্ত উপেক্ষা করে দেশ ও জনগণের স্বার্থবিরোধী সিদ্ধান্ত জনগণের উপর জবরদস্তিমূলকভাবে চাপিয়ে দিচ্ছে এই সরকার।

“এই প্রকল্পের মারাত্মক ক্ষতিকারক প্রতিক্রিয়ার সব প্রমাণ উপস্থাপনের পরেও সরকার তার অবস্থান পরিবর্তনে শুধু অস্বীকৃতি জানাচ্ছে না। বরং আরো দ্রুত এই গণবিরোধী দেশবিরোধী সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের উদ্যোগী হয়েছে। এর দ্বারা আবারো প্রমাণিত হলো যে, এই সরকার স্বৈরাচারী বলেই জনমত কিংবা দেশের স্বার্থের পরোয়া করে না”, বলেন বিএনপি চেয়ারপারসন।

তিনি বলেন, ‘কয়লাভিত্তিক এই প্রকল্প দেশের দক্ষিণাঞ্চলের প্রাকৃতিকবেষ্টনি ধ্বংস করবে, জীব-বৈচিত্রের বিলোপ ঘটাবে, লাখ লাখ মানুষের জীবন ও জীবিকা ধ্বংসের কারণ হবে, পরিবেশ ও পানি দূষিত করবে, আশেপাশের কৃষি জমির উর্বর শক্তি এবং মৎস সম্পদ ধ্বংস করবে। সর্বোপরি যে প্রকল্প অর্থনৈতিকভাবে অলাভজনক, তা বাস্তবায়নে সরকারের যুক্তিহীন জেদ ও দ্রুততা শুধু সন্দেহজনক নয়, দেশবাসীর জন্য গভীর উদ্বেগের বিষয়।’

সুন্দরবনকে নিশ্চিত ধ্বংসের শিকার করার চক্রান্ত সফল হতে দেওয়া যায় না- মন্তব্য করে বিএনপি নেত্রী বলেন, ‘দেশের অস্তিত্ব ও স্বার্থের বিনিময়ে ব্যক্তি কিংবা গোষ্ঠীর মুনাফা এবং অনৈতিক স্বার্থ উদ্ধারের অপচেষ্টা রোধ করা তাই সময়ের দাবি।’

তিনি বলেন, ইউনেস্কো ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ কর্তৃপক্ষ, রামসার কনভেনশনের সচিবালয়- এমন কি বাংলাদেশের বন অধিদপ্তরের আপত্তি অগ্রাহ্য করে সরকার এই প্রকল্পের কাজ চালিয়ে যাচ্ছে। স্থানীয় জনগণের প্রতিবাদ-প্রতিরোধ উপেক্ষা করে, তাদেরকে উপযুক্ত ক্ষতিপূরণ না দিয়ে প্রায় ৮ হাজার পরিবারকে জোর করে উচ্ছেদ করা হয়েছে।

খালেদা জিয়া বলেন, ভারতের ন্যাশনাল থার্মাল পাওয়ার করপোরেশন নামের যে প্রতিষ্ঠানটির সঙ্গে যৌথভাবে রামপাল কয়লা-বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপিত হচ্ছে, সেই একই প্রতিষ্ঠান ভারতের মধ্য প্রদেশের নরসিংহপুর জেলায় ১৩২০ মেগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন কয়লা-বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের যে প্রস্তাব দিয়েছিল। ভারত সরকার তা বাতিল করে দিয়েছে। নরসিংহপুর প্রকল্পটি ১০০০ একর জমির উপর প্রতিষ্ঠা করার প্রস্তাব ছিল- অথচ রামপালে এই একই আকারের বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের জন্য দেওয়া হয়েছে ১৮৩৪ একর জমি।

“ভারতে সংরক্ষিত বনাঞ্চলের ২৫ কিলোমিটারের মধ্যে কয়লা-বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপনে আইনী বাধা আছে। অথচ সে দেশেরই একটি রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান তাদের নিজের দেশে যা করতে পারে না শুধুমাত্র ব্যবসায়ীক স্বার্থে তা বাংলাদেশে করছে। আর জনগণের প্রতি দায়িত্বহীন এবং দেশের স্বার্থের প্রতি উদাসীন বাংলাদেশ সরকার তার অনুমতি দিয়েছে”, বলেন প্রাক্তন এই প্রধানমন্ত্রী।

পরিবেশের দুষণের কথা চিন্তা করে ভারতের বিভিন্ন প্রদেশে কয়লাভিত্তিক প্রকল্পগুলো বাতিল করা হয়েছে বলেও জানান বিএনপি নেত্রী।

তিনি বলেন, আমেরিকার টেক্সাসে ফায়েত্তি কয়লা-বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে বছরে ৩০ হাজার টন সালফারডাই অক্সাইড নির্গত হতো। এর ফলে টেক্সসের হাইওয়ে ২১’-এর ৪৮ কিলোমিটার জুড়ে গাছপালা ধ্বংস হয়েছে। ফলে প্রকল্পটি বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া এটা বৈজ্ঞানিকভাবে প্রতিষ্ঠিত যে, কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে পানি নির্গমণ হলে তাতে বিভিন্ন মাত্রার দূষণকারী উপাদান থাকে। সে কারণে পৃথিবীর সব দেশে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের ক্ষেত্রে ‘শূন্য নির্গমণ’ নীতি অবলম্বন করা হয়।

খালেদা জিয়া বলেন, রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে প্রতি ঘণ্টায় নির্গত ৫১৫০ ঘনমিটার পানি ‘পশুর নদী’র জলজ পরিবেশের তাপমাত্রা, পানি নির্গমণের গতি, পানিতে দ্রবীভূত নানান উপাদান বিভিন্ন মাত্রায় পরিবর্তন করবে, যা পুরো সুন্দরবন এলাকার পরিবেশের উপর ধ্বংসকারী প্রভাব সৃষ্টি করবে।

দেশ বিদেশে এই প্রকল্পের বিরুদ্ধে মানুষ প্রতিবাদ জানাচ্ছে জানিয়ে বিএনপি প্রধান বলেন, ‘প্রতিদিনই বিশ্বের কোথাও না কোথাও কোন না কোনো মানবতাবাদী ও পরিবেশবাদী সংগঠন এই জনস্বার্থ ও পরিবেশ বিপন্নকারী প্রকল্পের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাচ্ছে। বাংলাদেশেও সচেতন জনগণ এই প্রকল্পের বিরুদ্ধে সোচ্চার। কিন্তু সরকার শুধু অনমনীয় নয়, শক্তি প্রয়োগের মাধ্যমে এই প্রতিবাদ-প্রতিরোধ আন্দোলনকে দমন করে চলেছে।’

দ্রুত শিল্পায়ন, অর্থনৈতিক অগ্রগতি ও জনগণের চাহিদা মেটানোর জন্য প্রয়োজনীয় বিদ্যুৎ উৎপাদন সময়ের দাবি হলেও জাতীয় স্বার্থ বিসর্জন দেওয়ার কোনো সুযোগ নেই বলেও মন্তব্য করেন খালেদা জিয়া।

তিনি বলেন, বিদ্যুৎ সমস্যার সমাধানের জন্য বিকল্প বিদ্যুৎ ও বিকল্প জ্বালানির সন্ধান করা উচিত। ছোট গ্যাস জেনারেটর বিদ্যুৎকেন্দ্র, পানি বিদ্যুৎ, টাইডাল বিদ্যুৎ, বায়োগ্যাস প্রকল্প, সোলার এনার্জি ইত্যাদি বিষয়ের দিকে আমাদের মনোযোগী হওয়া দরকার।

“সুন্দরবনের মতো প্রাকৃতিক বর্ম ধ্বংস করে দেশকে প্রাকৃতিক দুর্যোগে অরক্ষিত না করে প্রকৃতিবান্ধব ও সাশ্রয়ী উপায়ে জ্বালানির প্রয়োজন মেটানোর উদ্যোগ নেওয়া উচিত বলে আমরা মনে করি। গোটা বিশ্ব যখন আবহাওয়া ও জলবায়ু পরিবর্তনের অনিবার্য বিপদ নিয়ে গভীর উদ্বিগ্ন,  তখন জেনে-শুনে এই দেশকে নিশ্চিত বিপদের দিকে ঠেলে দেওয়ার যে কোনো অপচেষ্টার প্রতিবাদ করার দায়িত্ব আমাদের সকলের”, বলেন খালেদা জিয়া।

সংবাদ সম্মেলনে বিএনপি নেতাদের মধ্যে দলটির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন, তরিকুল ইসলাম, গয়েশ্বর চন্দ্র রায়, নজরুল ইসলাম খান, আমির খসরু মাহমুদ চৌধুরী উপস্থিত ছিলেন।

২০ দলীয় জোটের নেতাদের মধ্যে বিজেপি সভাপতি আন্দালিব রহমান পার্থ, জাতীয় পার্টির (কাজী জাফর) মহাসচিব মোস্তফা জামাল হায়দার, জাগপা সভাপতি শফিউল আলম প্রধান, কল্যাণ পার্টির চেয়ারম্যান সৈয়দ মুহাম্মদ ইবরাহিম, লেবার পার্টির চেয়ারম্যান মোস্তাফিজুর রহমান ইরান, খেলাফত মজলিসের আহমেদ আবদুল কাদের, বাংলাদেশ ন্যাপ মহাসচিব এম. গোলাম মোস্তফা ভুঁইয়া, বাংলাদেশ মুসলিম লীগের শেখ জুলফিকার বুলবুল চৌধুরী, ডিএলের মহাসচিব সাইফুদ্দিন আহমেদ মনি, ন্যাপ ভাসানীর আজহারুল ইসলাম প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন।

শেয়ার করুন

Author:

Etiam at libero iaculis, mollis justo non, blandit augue. Vestibulum sit amet sodales est, a lacinia ex. Suspendisse vel enim sagittis, volutpat sem eget, condimentum sem.

0 coment rios: