শুক্রবার, ৩০ ডিসেম্বর, ২০১৬

ফেসবুক হোক সামাজিক সচেতনতা বৃদ্ধির হাতিয়ার

স্বদেশসময় টোয়েন্টিফোর ডটকম

জেবুন্নেসা চপলা, সাস্কাতুন (কানাডা) থেকে |
লেখিকা        
একটা সময় গেছে বাংলাদেশে প্রবীণ-যুবক সকলেই নিজেদের অনুভূতি প্রকাশ করার জন্য শুধুমাত্র ফোন ব্যবহার করত। ভাবনা চিন্তাগুলোকে শেয়ার করার জন্য বা ছড়িয়ে দেওয়ার জন্য অনেক দূর থেকে এসে বন্ধুদের আড্ডায় (পার্ক, ক্লাব, ক্যাম্পাস, রাস্তার মোড়, রেস্টুরেন্ট বা ড্রয়িংরুম আড্ডায়) অংশগ্রহণ করতে হতো। লেখালেখি মানুষজনকে তেমন একটা করতে হতো না পরীক্ষার খাতা, চাকরির দরখাস্ত আর প্রেমপত্র লেখা ছাড়া। এর মধ্যে প্রেম পত্রলেখা লেখায় মৌলিক চিন্তার প্রয়োজন হতো। মুখস্থ বিদ্যায় কাজ হতো না। পেছন ফিরে তাকালে আজ মনে হয় একমাত্র প্রেমপত্রের ক্ষেত্রেই শুধুমাত্র আমাদের লেখনীর সৃজনশীলতা দেখাবার সুযোগ মিলত। প্রচুর চিন্তা করতে হতো। কারণ নানা প্রতিকূল অবস্থার মধ্যে দিয়ে প্রেমপত্র লিখতে হতো। অনেক কাগজের পৃষ্ঠা বলি দেওয়ার ফসল হতো এক পাতার নিরেট ভালোবাসার গল্প বা প্রেমের চিঠি। যাকে আমরা একমাত্র মৌলিক সৃষ্টি বলতে পারি। আর হ্যাঁ, সমাজ ও চারপাশের পরিবেশ নিয়ে চিন্তা করা আর লেখালেখির কাজটা একচেটিয়া লেখক, কবি, সাহিত্যিক আর গণমাধ্যমগুলোর সাংবাদিকদেরই ছিল। কিন্তু সময় বদলেছে, আজ মানুষ ফোনেও টেক্সট লিখে কথা বলে। আর টুইটার, ফেসবুকতো আছেই, নিজের ভাবনা প্রকাশের মাধ্যম যাকে আমরা ডিজিটাল বন্ধুদের আড্ডার স্থল বলি।
প্রতীকী ছবি। সংগৃহীতআমি গত নয় বছর ধরে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহার করছি। সেই অভিজ্ঞতা থেকে বলছি, ফেসবুক বা ব্লগে লিখতে লিখতে গুণগত মানের চিন্তা ও সৃষ্টিশীল অনেক ভালো লেখক তৈরি হচ্ছেন চারপাশে। একটু মনোযোগ দিলেই তা দেখতে পাওয়া যায়। যদিও তারা সংখ্যায় খুবই কম। মানুষ অনেকের লেখাই হয়তো ফেসবুকে পড়েন না বা তারা হয়তো প্রফেশনাল বা নামকরা লেখক নন আমাদের চোখে। এত এত পোস্টের ভিড়ে অনেকের লেখাই আমাদের পড়া হয়ে ওঠে না। কিন্তু পাঠকেরা পড়ুন বা নাই পড়ুন, সমাজ তাদের বড় মাপের লেখক বলুক আর নাই বলুক, আমি ব্যক্তিগতভাবে সম্মান করি সেই সকল নবীন সাহসী লেখকদের। কারণ আমি দেখতে পাই মানুষ নিজেকে প্রকাশ করবার জন্য ফেসবুকের স্বাধীনতাটা উপভোগ করছেন। অনেকের সঙ্গে ভাব বিনিময়, বন্ধুত্ব করে একধরনের মানসিক পরিতৃপ্তি পাচ্ছেন। সাধারণত ভেবে না দেখা অনেক বিষয় নিয়ে তারা ভাবতে শিখছেন ও ক্রিটিক্যালি চিন্তা করছেন। প্রশ্ন করতে শিখেছেন চারপাশের রাজনৈতিক, সামাজিক ভেদ-বৈষম্য, সুশাসনের সমস্যা, দুর্নীতি, ক্ষমতাবানদের ক্ষমতার অপব্যবহার, সন্ত্রাস, সাম্প্রদায়িকতা, ধর্মীয় গোঁড়ামি, সামাজিক কুসংস্কার, বিজ্ঞান ও মানবাধিকার লঙ্ঘন নিয়ে। যা নিয়ে আমরা সচরাচর সমাজে খোলাখুলি আলোচনা করতে ভয় পাই এবং সমাজ, পরিবার, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান উৎসাহ জোগায় না সেসকল চ্যালেঞ্জিং প্রশ্ন করতে।
ফেসবুকে যারা ক্রিটিক্যালি লিখছেন, সেই মানুষটি জাগ্রত তার চেতনা ও লেখনীতে। ডিজিটাল সামাজিক আড্ডার মাধ্যমে অন্যকে জাগাতে চেষ্টা করছেন, সচেতনতা তৈরি করতে চাচ্ছেন বিভিন্ন সোশ্যাল জাস্টিস বিষয়ে। সমাজের অনেক মানুষ চিন্তার খোরাক নেই বলে হিন্দি সিরিয়াল, বাংলা ছবির গান বা স্থূল রুচির বিনোদন মাধ্যমগুলো দেখা বা শোনায় ব্যস্ত। আবার অনেকে এই ফেসবুকেই সাজসজ্জা, দেখানোপনা জাতীয় খাওয়া-দাওয়া, মেধাহীনভাবে ব্যক্তিগত প্রচারের উন্মাদনা আর অশালীনভাবে সামাজিক প্রতিপত্তি দেখানোপনা নিয়ে ব্যস্ত। তাদের চাইতে এই ইনফরমালভাবে লেখালিখির দলটা অনেক উন্নতমানের চিন্তাশীল মানুষ এবং নিঃসন্দেহে তারা শ্রদ্ধাভাজন।
আমি দেখেছি, তারা অনেকেই মানব জীবনের দুর্লভ অভিজ্ঞতালব্ধ দর্শন (Experiential learning) তুলে আনেন তাদের লেখনীতে। যা অনেক সময় গভীর ও চিরন্তন সত্যের প্রতি দিক নির্দেশনা দেয়। আর সমাজকে নিয়ে যারা ভাবেন তারাই একদিন সমাজকে কিছু দেওয়ার জন্য এগিয়ে আসবেন নিজেদের অজান্তেই। হয়তো ইনফরমাল লেখালিখির সেই অদৃশ্য প্রভাব বা এর অবদানকে খালি চোখে আমরা দেখতে পাই না বলে এর গুরুত্ব বুঝি না। কিন্তু চিন্তাশীল মানুষ তৈরি করাটাই কি শিক্ষার ও জীবনের লক্ষ্য হওয়া উচিত নয়? কারণ আমি বিশ্বাস করি ফেসবুকের এই সাধারণ চিন্তাশীলতাই একদিন সৃষ্টিশীল, রুচিমান, তীক্ষ্ণ যুক্তিবাদী মানুষ তৈরি করবে। একজন সৃষ্টিশীল, রুচিমান মানুষের আত্মা কখনোই পরিবার-সমাজের অমঙ্গলকর চিন্তা এবং কর্ম করবে না। নিজের মনের ভেতরের প্রশ্নগুলোকে লুকিয়ে না রেখে আলোচনা করলে একধরনের জ্ঞান তৈরি হয়। যা নিজের চিন্তাকে সমৃদ্ধ করে। যারা সেই আলোচনা পড়েন বা শোনেন তারাও সচেতন হন এবং সামগ্রিকভাবে সমাজ উৎকর্ষ সাধন করে।
কোনো লেখকের কী বই পড়লাম, কী জানলাম সেই বই থেকে, বা কোন ফিল্ম দেখলাম তা কেন অন্যদের দেখা উচিত বা উচিত নয়, স্বাস্থ্যবিষয়ক আলোচনা, যেকোনো সামাজিক বিষয়ে সচেতনতা তৈরিতে কথা বলবার জন্য সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমকে ব্যবহার করে নিজে উপকৃত হতে পারি। এর মাধ্যমে সমাজের জন্য ইতিবাচক প্রভাব তৈরি করা সম্ভব। যার অনেক উদাহরণ তৈরি হয়ে গেছে আমাদের অনেকের অজান্তেই। তাই অভিভাবকদের দায়িত্ব হবে ঘর থেকেই ছেলেমেয়েদের শিখিয়ে দেওয়া কেমন করে তারা নিজেকে ফেসবুকে তুলে ধরবে, কোন বিষয় নিয়ে সামাজিক মাধ্যমে নিজ বক্তব্য তুলে ধরতে হবে বা হবে না ইত্যাকার সাধারণ কিন্তু জরুরি পরামর্শ। শিক্ষকেরাও অগ্রণী ভূমিকা পালন করতে পারেন এ বিষয়ে। শিক্ষার্থীদের সঙ্গে শিক্ষকদের বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক ভীষণ জরুরি এবং আমাদের দেশে তার অভাব রয়েছে তা আর নতুন করে নাই বললাম। শিক্ষকেরাও শিক্ষার্থীদের কাউন্সেলিং ও প্রয়োজনীয় তথ্য শেয়ার করতে পারে এবং নিজ নিজ ক্রিয়েটিভ ভাবনা থেকে এর বিভিন্ন উপযোগিতা বের করতে পারেন।
প্রযুক্তিকে খারাপ বলে দূরে সরিয়ে না দিয়ে এর যথাযথ ব্যবহার শিখে নেওয়াটা বুদ্ধিমানের কাজ হবে বলে আমি মনে করি। করপোরেট বাণিজ্যের শিকারে পরিণত হয়ে আমরা আজ সত্যের মুখোমুখি হতে ভুলে গেছি। রং মেখে সং সেজে একটা রাংতা কাগজের মতো চাকচিক্যময় জীবনকে তুলে ধরবার চেষ্টা করছি ফেসবুকের মাধ্যমে প্রতিনিয়ত। আমরা ভুলে যাই যে, পৃথিবীতে অনেক মানুষ আছেন যারা সাদাসিদা আটপৌরে বেশ ও মননে জীবন কাটাতে চান। কারণ তারা জানেন, গ্ল্যামার ক্ষণস্থায়ী। এই দেখানোপনার সংস্কৃতির মধ্যে জীবনের অন্তর্নিহিত সত্য লুকিয়ে নেই। প্রাপ্তি নেই। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমকে যদি আমরা সামাজিক-মানবিক আন্দোলনের জন্য ব্যবহার করতে পারি তাহলে পৃথিবীটা হবে অন্যরকম সমৃদ্ধ ও সুন্দর। আমরা কি এই বিষয়টা ভেবে দেখেছি কখনো?
প্রতীকী ছবি। সংগৃহীতআসুন সবাই সৃষ্টিশীল, সকলের জন্য ইতিবাচক ভাবনা ও চিন্তার খাদ্য দিবে এমন ধরনের ভাবনা শেয়ার করার জন্য ফেসবুক ব্যবহার করি। জনসচেতনতা তৈরি করার জন্য এই স্পেসটিকে ব্যবহার করি। সেই সঙ্গে কুশল বিনিময়, অন্যকে উৎসাহিত করার জন্য নিজেদের দৈনন্দিন জীবনের কিছু অর্জন, জীবনের বিশেষ মুহূর্ত, গল্প, ভ্রমণকাহিনি, ভালো লাগার স্মৃতি, খারাপ লাগা, কিছুটা হতাশা, জিজ্ঞাসা পৌঁছে দেওয়ার জন্য এই মাধ্যমটিকে ব্যবহার করি। অবাধে প্রকাশ করতে পারার, জ্ঞানের রাজ্যে হারাবার এই স্বাধীনতাটুকুকে পুরোপুরি উপভোগ করার সুযোগটা নেওয়া উচিত। এই সুযোগটাকে কাজে লাগানো উচিত সৃষ্টিশীল ভাবনা ও লেখনীর মাধ্যমে। লেখালিখি করার জন্য বন্ধু মহল বা ক্লাব তৈরি করতে পারি (Writer's Club), ফেসবুকের মাধ্যমে। আসুন সকলে ক্রমাগত লিখতে থাকি, ভাবতে থাকি আর ভাবনার আলোটা অন্যের মধ্যে ছড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টা করি সহজ সরল মাধ্যম ফেসবুকের মাধ্যমে। যা এখন আমাদের অনেকেরই মুঠোর মধ্যে।
আর হ্যাঁ, আমরা পরমতসহিষ্ণু জাতি, এই কথাটাও মনে রাখবেন। অন্যের লেখা বা প্রতিবাদ, সমালোচনা বা বিশ্লেষণ পড়ে রেগে ফেসবুক অ্যাকাউন্ট বন্ধ না করে বা মারামারি, কাটাকাটি, নেতিবাচক তর্কাতর্কি না করে আসুন শৈল্পিকভাবে বিতর্ক করতে শিখি এই ফেসবুকের মাধ্যমেই। কারণ অনেকের কাছেই ফেসবুক তাদের কাছে, যেমন ইচ্ছে লেখার কবিতার খাতা, ঠিক শামসুর রাহমানের মতন। পৃথিবী এগিয়ে যাচ্ছে প্রতিদিন আর এই গতিমান পৃথিবীর সঙ্গে তাল মেলাতে হলে ফেসবুক, ইন্টারনেট ব্যবহারের প্রতি নিয়ন্ত্রণ আনবার কথা না বলে বলুন কেমন করে গুণগত মানের ভাবনা (Quality of thoughts) ভাবতে হবে? আসলে কীভাবে সৃষ্টিশীল ভাবনা ভাবতে হয় সেটাও শিখতে হয়।
আমার ফেসবুক ও বিশ্ববিদ্যালয়ের বন্ধু আবু সালেহ সোহাগ একদিন ফেসবুকে লিখেছিল কেউ আপনা থেকেই বিশ্লেষণমূলক, মূল্যবোধ নিরপেক্ষ, নৈর্ব্যক্তিক, বস্তুনিষ্ঠ, মানবিক, যৌক্তিক, ন্যায়ানুগ, স্বচ্ছ, নির্মোহ, সর্বজনীন ও সবার জন্য সমান দৃষ্টিভঙ্গিমূলক চিন্তা করতে পারে না। আমি তাঁকে প্রত্যুত্তরে বলেছিলাম কেউ কেউ নিজে থেকেই ভাবতে পারে আবার কেউ অন্যকে দেখে শেখে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম এই সারা বিশ্বের বৈচিত্র্যময় ভাবনাগুলোকে দেখার সুযোগ করে দেয়। গঠনমূলক সমালোচনা করা ​ও বিতর্ক করতে শেখাও একটা শিক্ষা, যোগ্যতা, শিল্প ও সবশেষে একটা অর্জন। আসুন সকলে মিলে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমটিকে ভালোবেসে, সম্মানের সঙ্গে, নিরাপদে ব্যবহার করি। ফেসবুক মানুষের সুপ্ত চিন্তা চেতনার দর্পণ এবং এই মাধ্যম টিকে সমাজ পরিবর্তনে ব্যবহার করার কথা ভেবে দেখা যেতে পারে। ফেসবুক হোক সকলের পরিশীলিত ভাবনার বহিঃপ্রকাশ।
*জেবুন্নেসা চপলা: সাংস্কৃতিক ও মিডিয়া কর্মী। সাস্কাতুন, সাস্কাচেওয়ান, কানাডা।

শেয়ার করুন

Author:

Etiam at libero iaculis, mollis justo non, blandit augue. Vestibulum sit amet sodales est, a lacinia ex. Suspendisse vel enim sagittis, volutpat sem eget, condimentum sem.

0 coment rios: