রবিবার, ১ অক্টোবর, ২০১৭

‘‘অক্ষরযোজনার মাধ্যমে বাংলার প্রাচীন মুদ্রণকৌশল’’ প্রদর্শনী

স্বদেশসময়২৪ডটকম
বাংলার মুদ্রণশিল্পের ইতিহাসের কমপক্ষে চারটি দিক আছে: প্রথমত, বাংলা অক্ষরসম্বলিত কিছু মুদ্রণ; দ্বিতীয়ত, বাংলাদেশে মুদ্রণশিল্প স্থাপন ও তার বিকাশ; তৃতীয়ত, মুদ্রণের  জন্য বাংলা মুদ্রাক্ষর বা টাইপ তৈরি এবং চতুর্থত, বিচল মুদ্রাক্ষর দিয়ে বাংলা ভাষায় গ্রন্থ ও সাময়িকী মুদ্রণ।
মুদ্রণের জন্য বিচল অক্ষর সুপ্রচলনের পূর্বে কাষ্ঠফলক, তাম্রফলক এবং সমধর্মী অন্যান্য বস্ত্তর ওপর খোদাই করে মুদ্রণকর্ম সম্পন্ন করা হতো। এ উপায়ে বাংলা ভাষার পুঁথিপত্রও মুদ্রিত হয়েছিল বলে দীনেশচন্দ্র সেন জানিয়েছেন। ১৬৬৭ খ্রিষ্টাব্দে প্রকাশিত ‘চায়না ইলাস্ট্রাটা’ গ্রন্থ এবং ১৬৯২ খ্রিষ্টাব্দে প্যারিস থেকে প্রকাশিত Observations physiques et mathematiques pour servir a L’histoire naturelle Envoyees des Indes গ্রন্থের ৭৩ সংখ্যক পৃষ্ঠায় রোমান অক্ষরের সমস্থানীয় হিসেবে বাংলা অক্ষরের মুদ্রিত রূপের দেখা পাওয়া যায়।
মুদ্রণযন্ত্র আবিষ্কারে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখার জন্য জার্মানির গুটেনবার্গ সর্বজনবিদিত। তাঁর সময়েরও আগে চীন দেশে বিচল টাইপ, অর্থাৎ মুদ্রাক্ষরের প্রচলন ছিল। বাংলাদেশে বাংলা বিচল মুদ্রাক্ষরসম্বলিত প্রথম ছাপা গ্রন্থটি হলো ন্যাথানিয়েল ব্যাসি হ্যালহেড কর্তৃক রচিত A Grammar of the Bengal Language, যা ১৭৭৮ খ্রিষ্টাব্দে হুগলীর সেইন্ট অ্যান্ড্রুজ প্রেসে মুদ্রিত হয়েছিল।

২০৯ পৃষ্ঠার এই গ্রন্থটি ইংরেজিতে লিখিত বাংলা ব্যাকরণ, যাতে বাংলা অক্ষর ব্যবহার করা হয়েছিল। উল্লেখযোগ্য যে, হ্যালহেড সাহেব কর্তৃক রচিত এবং ১৭৭৬ খ্রিষ্টাব্দে লন্ডনে মুদ্রিত A Code of Gentoo Laws গ্রন্থেও বাংলা অক্ষর মুদ্রিত হয়েছিল।
ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কর্মকর্তা হ্যালহেড কর্তৃক রচিত A Grammar of the Bengal Language গ্রন্থটিতে ব্যবহারের জন্য সর্বপ্রথম বিচল টাইপ বা মুদ্রাক্ষর প্রস্ত্তত করেছিলেন তাঁরই সংস্কৃতজ্ঞ সহকর্মী চার্লস উইলকিন্স। তাঁরই নির্মিত মুদ্রাক্ষরে এন. বি. এডমনস্টৌন অনূদিত Regulations for the administration of justice in the Fouzdaary or Criminal Courts of Bengal, Behar and Orissa গ্রন্থটির অক্ষরযোজনা করা হয়েছিল। এটি মুদ্রিত হয়েছিল কলকাতায়, ১৭৯১ খ্রিষ্টাব্দে।

চার্লস উইলকিন্সকে মুদ্রাক্ষর বা টাইপ প্রস্ত্ততির কাজে সাহায্য করেছিলেন বাঙালি কামার পঞ্চানন কর্মকার। পঞ্চানন কর্মকার মুদ্রাক্ষর বা টাইপ তৈরির কাজ ভালোভাবেই রপ্ত করেছিলেন। উইলকিন্স সাহেবের ভারত ত্যাগের পর তিনি টাইপ তৈরির ব্যবসায় শুরু করেন। উইলিয়াম কেরী শ্রীরামপুরে মুদ্রাক্ষর নির্মাণের  কারখানা স্থাপন করলে সেখানে পঞ্চানন কর্মকারকে প্রধান কারিকর নিযুক্ত করা হয়। ১৮০৩ খ্রিষ্টাব্দে তাঁর মৃত্যু হয়েছিল।
ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের সেরেস্তাদার কালিকুমার রায়ের হস্তাক্ষর ছিল সুন্দর। তাঁর হস্তাক্ষর অনুসরণ করে উইলিয়াম কেরী পঞ্চানন কর্মকার ও তদীয় জামাতা মনোহর কর্মকারকে দিয়ে এক প্রস্থ বাংলা মুদ্রাক্ষর প্রস্ত্তত করিয়েছিলেন। লক্ষ করার বিষয় এই যে, সিসার বিচল হরফ বা মুদ্রাক্ষর তৈরির সময় বাংলা হস্তলিখিত অক্ষরের বক্ররেখার আধিক্যকে বাদ দেওয়া হয়েছে; কারণ বাঁকা ছাদের হস্তাক্ষর অনুসারে সিসার হরফ কাটা ছিল দুরূহ একটি কাজ। ফলে বিচল মুদ্রাক্ষর বা টাইপে বর্ণমধ্যে ঋজু সরলরেখার ব্যবহার বৃদ্ধি পেয়েছে। ছাপার যুগে আবির্ভাব ঘটেছে খাড়া মুদ্রাক্ষরের, যা মূলত একটি চৌকো কাঠামোতে সীমাবদ্ধ।
আরো একটি লক্ষণীয় বিষয় এই যে, সিসার মুদ্রাক্ষর নির্মাণের সময়, বিশেষ করে যুক্তাক্ষর, ফলাযুক্ত ব্যঞ্জনবর্ণ, সংকুচিত অক্ষর ইত্যাদির ক্ষেত্রে কৌতূহলোদ্দীপক পরিবর্তন সাধিত হয়েছিল। যাঁরা এই যুক্তাক্ষর ও ফলাযুক্ত ব্যঞ্জনবর্ণসমূহের নকশা করেছিলেন, তাঁরা যে যুক্তি ও সৃষ্টিশীলতার পরিচয় দিয়েছিলেন তা আজো কম্পিউটারের ফন্ট ডিজাইনের জন্য অনুসরণীয়।
ইংরেজি তথা রোমান বর্ণমালার জন্য ছাবিবশটি অক্ষর যথেষ্ট। তবে বাংলা গ্রন্থ মুদ্রণের জন্য পাঁচশ’রও বেশি অক্ষর প্রয়োজন। এর কারণ যুক্তাক্ষর। বাংলা ছাপাখানায় মুদ্রাক্ষর বিন্যাসের জন্য কাঠের বাক্সে ৪৫৬টি খোপ প্রয়োজন হয়। অক্ষরযোজক অর্থাৎ কম্পোজিটররা এই ৪৫৬ টি মুদ্রাক্ষরের কোনটি কোন খোপে আছে তা মুখস্থ রাখতেন এবং দ্রুত হাত চালিয়ে শব্দ রচনা করতেন।
বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘর কুষ্টিয়ার কুমারখালিতে কাঙ্গাল হরিনাথ স্মৃতি জাদুঘর প্রতিষ্ঠা করেছে। সাংবাদিক কাঙ্গাল হরিনাথকে কেন্দ্র করে প্রাচীন মুদ্রণযন্ত্রে বাংলা মুদ্রণের একটি ইতিহাস এ জাদুঘরে রূপায়িত করা হয়েছে। এরই ধারাবাহিকতায় বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘর ‘অক্ষরযোজনার মাধ্যমে বাংলার প্রাচীন মুদ্রণকৌশল’ প্রদর্শনের ব্যবস্থা করেছে।


প্রদর্শনীটি গত ০৯ সেপ্টেম্বর ২০১৭ তারিখে শূরু হয় এবং মাসব্যাপী এ প্রদর্শনীটি চলবে। উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে স্বাগত ভাষণে মহাপরিচালক  ফয়জুল লতিফ  চৌধুরী বলেন, লেটার প্রেস হারিয়ে গেছে। ভুরুঙ্গামারীতে ১৮ শতকের মধ্য ভাগ থেকে এই লেটার প্রেসটি চালু রয়েছে। সমকালীন সভ্যতাকে ধারণ করার জন্য যে সমস্ত উপাদান এখনো টিকে আছে তার মধ্যে মুদ্রণযন্ত্র অন্যতম।
বিশেষ অতিথি হিসেবে মুদ্রণযন্ত্র নিয়ে বিশিষ্ট লেখক, কলামিস্ট আবুল মোমেন বলেছেন, এই প্রদর্শনীটি লিপির বিকাশ সম্পর্কে তরুণদের ধারণা দেবে । কোলকাতায় যে সীমিত রেনেসাঁ ঘটেছিল তার পেছনে মুদ্রণশিল্পের  একটি বড় ভূমিকা ছিল। বাংলাদেশে ৫০ এর দশক থেকে ৬০ এর  দশকে যে সাংস্কৃতিক জাগারণ ঘটে, সেখানে মুদ্রণ শিল্পের একটা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল।
গণমাধ্যম ব্যক্তিত্ব ড.মুহাম্মদ জাহাঙ্গীর বলেন, ট্রেডল মেশিন, গেলি, নিউজ প্রিন্ট ভিজিয়ে প্রুফ দেখা এসব কষ্টসাধ্য কাজগুলোর ইতিহাস উত্তরসুরীদের কাছে পৌঁছে দেয়া প্রয়োজন। জাতীয় জাদুঘর এই প্রদর্শনীর মাধ্যমে এই কষ্টসাধ্য কাজটি করেছে ।
 বিশিষ্ট লেখক আলী ইমাম আবেগতাড়িত কণ্ঠে বলেন, সভ্যতার সূত্রপাত ঘটে লিপির মধ্য দিয়ে। লিপি থেকে অক্ষর এই ভাবে সভ্যতার বিকাশ ঘটে। লিপি থেকেই মুদ্রণশিল্পের বিকাশ ঘটে।  ১৮৪০ এ বর্ণ পরিচয় ছাপা হলো ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাগাসারের কল্যাণে। বাংলা টাইপোগ্রাফি দৃঢ়তা পেলো। বাংলা টাইপের সুশোভন রূপ দেয়ার ক্ষেত্রে সত্যজিৎ রায়েরও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে ।
প্রধান অতিথি সিনিয়র সচিব হেদায়েততুল্লাহ আল-মামুন বলেন, মানুষের সমান অধিকার প্রতিষ্ঠায় মুদ্রণশিল্পের বিশাল ভূমিকা রয়েছে। মুদ্রণশিল্প মানুষের সমান অধিকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলনের  ইতিহাসে  একটা বড় ধরনের ঐতিহাসিক বিপ্লব ঘটায়। বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার পেছনে যে সংগ্রাম, আন্দোলন ঘটেছে সে  ক্ষেত্রেও মুদ্রণশিল্পের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে।
বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘর ট্রাস্টি বোর্ডের সভাপতি শিল্পী হাশেম খান বলেন, পঞ্চাশ ও ষাটের দশকে বাংলাদেশে সাংস্কৃতিক আন্দোলনের সাথে প্রকাশনা ও মুদ্রণশিল্পের ইতিহাস একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। বিজ্ঞানের উন্নতির ফলে মুদ্রণশিল্পের ইতিহাস হারিয়ে যাচ্ছে। সে জন্য জাদুঘরে মুদ্রণযন্ত্রের ইতিহাস নিয়ে এই প্রদর্শনী তরুণ প্রজন্মের মধ্যে বাংলাদেশ সৃষ্টির যে সাংস্কৃতিক আন্দোলন হয় তার সাথে মুদ্রণশিল্পের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা একটি চেতনার জন্ম দেবে।

‘‘অক্ষরযোজনার মাধ্যমে বাংলার প্রাচীন মুদ্রণকৌশল’’ প্রদর্শনীটি জাদুঘরের প্রধান লবিতে গত ০৯-০৯-২০১৭ তারিখ থেকে  মাসব্যাপী জাদুঘরের সময়সূচি অনুযায়ী দর্শকদের জন্য উন্মুক্ত থাকবে। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঐতিহাসিক ৭ই মার্চের ভাষণের কপি ট্রেডল মেশিনে ছাপিয়ে দর্শকদের মধ্যে বিলি করা হচ্ছে।

উল্লিখিত সংবাদ বিজ্ঞপ্তিটি আপনার বহুল প্রচারিত সংবাদ মাধ্যমে প্রচার/প্রকাশ করার জন্য অনুরোধ জানানো হলো।

শেয়ার করুন

Author:

Etiam at libero iaculis, mollis justo non, blandit augue. Vestibulum sit amet sodales est, a lacinia ex. Suspendisse vel enim sagittis, volutpat sem eget, condimentum sem.

0 coment rios: