সোমবার, ২৬ ডিসেম্বর, ২০২২

মেট্রোরেলকে গণপরিবহন হিসেবে কার্যকর করতে ৩০ ভাগ ভাড়া হ্রাস এবং মেট্রোস্টেশনের সাথে বহুমাধ্যমভিত্তিক পরিবহন ব্যবস্থা গড়ে তোলা দরকারঃ ড. আদিল মুহাম্মদ খান

ইনস্টিটিউট ফর প্ল্যানিং এন্ড ডেভেলপমেন্ট (আইপিডি) ইনস্টিটিউট ফর প্ল্যানিং এন্ড ডেভেলপমেন্ট (আইপিডি) আয়োজিত “রাজধানীর টেকসই পরিকল্পনায় মেট্রোরেলঃ প্রেক্ষিত ও করণীয়” শীর্ষক ‘আইপিডি পরিকল্পনা ও উন্নয়ন পর্যালোচনা’ অনুষ্ঠান ইনস্টিটিউট ফর প্ল্যানিং এন্ড ডেভেলপমেন্ট (আইপিডি) ঢাকার যোগাযোগ ও পরিবহন ব্যবস্থায় মেট্রোরেল এর সংযোজন তাৎপর্যপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে, যদি সাধারণ গণমানুষের জন্য এটার ভাড়া সাশ্রয়ী এবং মেট্রো স্টেশনে আসা যাওয়ার পথকে সুগম করা হয়। মধ্যবিত্তরাই এই গণপরিবহন বেশি ব্যবহার করবে, ফলে মেট্রোরেলের পর্যাপ্ত যাত্রীসংখ্যা নিশ্চিত করতে মেট্রোরেলের ভাড়া ৩০ শতাংশ কমানো দরকার এবং মেট্রোলাইনকে কেন্দ্র করে বহুমাধ্যমভিত্তিক সমন্বিত যোগাযোগ ব্যবস্থা গড়ে তোলা প্রয়োজন। মেট্রো স্টেশন গুলোর আশেপাশে পথচারী চলাচল, বাস-প্যারা টানজিট-কমিউনিটি ভিত্তিক সার্ভিস, সিএনজি-রিকশা-ব্যক্তিগত গাড়ি প্রভৃতি বাহনগুলোর মাধ্যমে সাধারণ মানুষ কিভাবে মেট্রো স্টেশনে আসবে বা স্টেশন হতে বিভিন্ন গন্তব্যে যাবে সে ব্যাপারে কার্যকর পরিকল্পনার মাধ্যমে মেট্রোরেল এর কার্যকর ব্যবহার নিশ্চিত করা সম্ভব হবে। এ বছর মেট্রোরেলের উদ্বোধন করা হলেও আগামী বছর উত্তরা থেকে আগারগাঁও হয়ে মতিঝিল পর্যন্ত এম আরটি ৬ লাইনের পুরোটা চালু হয়ে গেলে বিপুলসংখ্যক যাত্রীকে মেট্রোরেলের মাধ্যমে দ্রুত পরিবহন করা যাবে, যা নগরের পরিবহন ব্যবস্থায় ইতিবাচক পরিবর্তন আনতে সক্ষম হবে। পরিকল্পনা ও পরিবহন সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞদের পক্ষ থেকে উপরোক্ত মতামতগুলো উঠে এসেছে অদ্য ২৬ শে ডিসেম্বর, সোমবার, অনলাইনে ইনস্টিটিউট ফর প্ল্যানিং এন্ড ডেভেলপমেন্ট (আইপিডি) আয়োজিত ““রাজধানীর টেকসই পরিকল্পনায় মেট্রোরেলঃ প্রেক্ষিত ও করণীয়” শীর্ষক ‘আইপিডি পরিকল্পনা ও উন্নয়ন পর্যালোচনা’ অনুষ্ঠানে। পাশাপাশি মেট্রোরেলকে সাধারণ জনগণের পরিবহন হিসেবে গড়ে তুলতে নিম্ন মধ্যবিত্ত ও ন্যূনতম আয়শ্রেণী এবং ছাত্রদের জন্য ৫০ ভাগ ভাড়ার ব্যবস্থা করা এবং ৫ বছর পর্যন্ত বয়সীদের জন্য বিনা ভাড়ায় মেট্রো পরিবহনের ব্যবস্থা করবার দাবী করা হয় আইপিডি’র পক্ষ থেকে। অনুষ্ঠানের মূল প্রবন্ধে আইপিডি’র পক্ষ থেকে ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক এবং জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নগর ও অঞ্চল পরিকল্পনা বিভাগের অধ্যাপক পরিকল্পনাবিদ ড.আদিল মুহাম্মদ খান বলেন, যোগাযোগ ব্যবস্থায় বড় পরিবর্তনের পাশাপাশি মেট্রোরেল ভূমি ব্যবহার ও ব্যবস্থাপনার উপর উল্লেখযোগ্য প্রভাব রাখবে। মেট্রোরেলের কারণে স্টেশনের আশেপাশের এলাকার ভূমি ব্যবহারের ব্যাপক পরিবর্তন ঘটবে, যার আলামত ইতিমধ্যেই উত্তরা থেকে আগারগাঁও এলাকায় চোখে পড়ছে। মেট্রোরেলের কারণে এই এলাকার ভূমির মূল্য বেড়ে গিয়েছে এবং নতুন নতুন আবাসন প্রকল্পে তৈরি হচ্ছে। বৈশ্বিকভাবেই এই ধরনের রূপান্তর প্রক্রিয়ায় মেট্রোরেল হবার পূর্বে যে ধরনের এবং যে আয়শ্রেণীর লোকেরা এই সকল এলাকায় ইতিপূর্বে বসবাস করত, তারা নতুন ও তুলনামূলক উঁচু আয় শ্রেণীর মানুষ দ্বারা প্রতিস্থাপিত হয়, নগর পরিকল্পনার ভাষায় যাকে বলে হয় ‘জেনট্রিফিকেশন’ বা বসবাসকারী জনসংখ্যার শ্রেণী পরিবর্তন। ফলে নগর পরিকল্পনা ও ব্যবস্থাপনায় সঠিক নীতি কৌশল প্রণয়ন, বাস্তবায়ন ও যথাযথ উন্নয়ন নজরাদারি প্রয়োজন, যেন এই জেনিট্রিফিকেশন তুলনামূলকভাবে নিয়ন্ত্রণ করা যায় এবং মেট্রোরেলের সুফল সকল আয়-শ্রেণীর মানুষ পেতে পারে ও সার্বিক জনকল্যাণ নিশ্চিত করা যায়। পাশাপাশি ‘বেটারমেন্ট ফি বা ভূমির উন্নয়ন ফি’ আরোপের মাধ্যমে মেট্রোরেল প্রকল্পের ব্যয় পুনরুদ্ধার, স্টেশন প্লাজা নির্মাণের মাধ্যমে মেট্রো স্টেশনকে কার্যকর করা, মেট্রো করিডোরের দুইপাশে ‘ইন্টিগ্রেটেড করিডোর ডেভেলপমেন্ট ম্যানেজমেন্ট প্ল্যান’ তৈরি করা, মেট্রো স্টেশনের ৫০০ মিটার এর মধ্যে টেকসই ও অন্তর্ভূক্তিমূলক ‘ভূমি ব্যবহার ব্যবস্থাপনা পরিকল্পনা’ তৈরির প্রস্তাব করা হয় আইপিডি’র পক্ষ থেকে। পরিকল্পনাবিদ অধ্যাপক ড. আকতার মাহমুদ, উপদেষ্টা, ইনস্টিটিউট ফর প্ল্যানিং এন্ড ডেভেলপমেন্ট (আইপিডি) ও অধ্যাপক, নগর ও অঞ্চল পরিকল্পনা বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় বলেন, মেট্রোরেল ঢাকাবাসীকে সুশৃংখল গণপরিবহনের নতুন স্বাদ এনে দিবে। মেট্রোরেলের আশেপাশের পরিকল্পিত উন্নয়নের জন্য ছোট ছোট প্লট একত্রীকরণ বা ল্যান্ড কনসোলিডেশন করবার উদ্যোগ নেয়া দরকার। মেট্রোরেল চালু হলে যত্রতত্র পোস্টার লাগানো বন্ধ করা, স্টেশন অপরিচ্ছন্ন করা এবং যেখানে সেখানে ময়লা আবর্জনা না ফেলার জন্য মেট্রোর ব্যবহারকারীদের অনুরোধ করেন তিনি।   রাজউক এর নগর পরিকল্পনাবিদ মোঃ আশরাফুল ইসলাম বলেন, ঢাকার শহরের অতিরিক্ত জনসংখ্যার কারণে মেট্রো ব্যবস্থা অনিবার্য হয়ে পড়েছিল। তবে মেট্রোরেলকে কার্যকর করতে মেট্রোর পাশাপাশি সমন্বিত উপায়ে বাস সার্ভিস চালু করা এবং স্টেশনগুলোতে পর্যাপ্ত পদচারী সুবিধা ও গাড়ি পার্কিং সুবিধা রাখা প্রয়োজন। পাশাপাশি ঢাকার বিকেন্দ্রীকরণ করতে ঢাকার সাথে কাছাকাছি দূরত্বের আঞ্চলিক শহরগুলোর দ্রুত যোগাযোগ ব্যবস্থা গড়ে তোলতে হবে। টিওডি ডেভেলপমেন্ট ও স্টেশন প্লাজার কার্যকর উন্নয়ন ও ব্যবহার নিশ্চিত করে মেট্রোরেলের ব্যয় পুনরুদ্ধার করা সম্ভব বলে মন্তব্য করেন তিনি।   পরিকল্পনাবিদ মোহাম্মদ আরিফুল ইসলাম – পরিচালক, ইনস্টিটিউট ফর প্ল্যানিং এন্ড ডেভেলপমেন্ট (আইপিডি) বলেন, মেট্রো স্টেশনের ৫০০ মিটার এর মধ্যে ভবনের আকার-আয়তন-ব্যবহার সুনির্দিষ্টকরণ করা দরকার, যেন এলাকাভিত্তিক জনসংখ্যা, উন্নয়নের মাত্রা এবং অর্থনৈতিক কর্মকান্ডের নিয়ন্ত্রণ ও ব্যবস্থাপনা সংশ্লিষ্ট এলাকার জন্য টেকসই ও এলাকার ভারবহন ক্ষমতার সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ হয়। মেট্রো স্টেশনের ৫০০ মিটার প্রভাব বলয়ে বেসরকারী এপার্টমেন্ট ও ফ্ল্যাট প্রকল্পে বাধ্যতামূলক সাশ্রয়ী আবাসনের মাধ্যমে নিম্নবিত্তদের জন্য আবাসনের সুযোগ বৃদ্ধি করা দরকার।     যোগাযোগ বিশেষজ্ঞ এবং মেট্রোরেল সংশ্লিষ্ট ট্রানজিট ওরিয়েন্টেড ডেভেলপমেন্ট (টিওডি) প্রকল্পের পরামর্শক ড. আফসানা হক বলেন, মেট্রোরেলের আশেপাশের ভূমি ব্যবহার এবং স্টেশন প্লাজাকেন্দ্রিক পরিকল্পনার যে উদ্যোগ এখন নেয়া হচ্ছে, তা কয়েক বছর আগেই শুরু করা প্রয়োজন ছিল। এক্ষেত্রে সন্নিহিত নেইবারহুড বা পাড়া-মহল্লার বৈশিষ্ট্য ও ধরন অনুযায়ী স্টেশনগুলোর ডিজাইনে বৈচিত্র্য ও ভিন্নতা আনা দরকার।   উন্নয়ন বিশেষজ্ঞ মোঃ রেদওয়ানুর রহমান বলেন, বিশ্বের অধিকাংশ দেশেই মেট্রোরেল চালাতে রাষ্ট্রীয় ভর্তুকি দেয়া লাগে। বাংলাদেশে মেট্রোরেলে ভর্তুকীর পরিমাণ কমাতে এবং যাত্রীদের জন্য ভাড়া সহনীয় ও সাশ্রয়ী করতে মেট্রো স্টেশনে বিজ্ঞাপন এলাকা ও বাণিজ্যিক এলাকা সুনির্দিষ্ট করে লিজ দেয়াসহ বিভিন্ন আয়বর্ধক কর্মসূচী নেয়া প্রয়োজন।   মেট্রোরেলকে কার্যকর করতে ও ঢাকার টেকসই পরিকল্পনায় আইপিডি’র পক্ষ থেকে নিম্নের আরও কয়েকটি প্রস্তাব দেয়া হয়ঃ - টিওডি নীতিমালা তৈরি করবার ক্ষেত্রে ‘লো ইমপ্যাক্ট ডেভেলপমেন্ট’ নীতি অনুসরণ করা যেন নিম্ন মধ্যবিত্ত ও মধ্যবিত্ত শ্রেণীর মানুষকে ট্রানজিট স্টেশনের আশেপাশে ধরে রাখা যায় এবং জেনট্রিফিকেশন প্রভাব সীমিত মাত্রায় রাখা যায় - মেট্রো করিডোর এ মাঝারি ও প্রান্তিক ব্যবসায়ীদের স্বার্থ সুরক্ষা করবার জন্য প্রয়োজনীয় নীতিমালা তৈরি করা - টিওডি ডিজাইন করবার সময় সাশ্রয়ী আবাসন ও সামাজিক আবাসনকে অন্তর্ভূক্ত করা - আরএসটিপি রিভিশন প্রকল্পে ঢাকার জন্য ব্যয়সাশ্রয়ী, অর্থনৈতিক ও পরিকল্পনাগতভাবে উপযোগিতার নির্মোহ বিচার বিশ্লেষণপূর্বক ঢাকার ভবিষ্যত যোগাযোগ পরিকল্পনার পথনকশা তৈরি করা - মেট্রো রেল নির্মাণে অন্য দেশের তুলনায় আমাদের ব্যয় কেন কয়েকগুণ বেশী হল, সেটা বিশ্লেষণপূর্বক ভবিষ্যতে এ ধরনের প্রকল্পে ব্যয় সাশ্রয়ী নীতিমালা গ্রহণ করা - যোগাযোগ পরিকল্পনায় বিদেশী পরামর্শক নির্ভর প্রকল্প ও সম্ভাব্যতা যাচাই প্রকল্প থেকে সরে এসে দেশীয় বিশেষজ্ঞদের নেতৃত্বে প্রকল্প গ্রহণ ও বাস্তবায়ন - ঢাকার যোগাযোগ পরিকল্পনার সাথে ভূমি ব্যবহার ও নির্মিত এলাকার ভৌত বৃদ্ধি ও ব্যবহারের ধরণকে সমন্বয় করে সার্বিক উন্নয়ন পরিকল্পনা গ্রহণ করা। এক্ষেত্রে আন্তঃসংস্থা সমন্বয় নিশ্চিত করতে হবে। - টংগী-এয়ারপোর্ট-বনানী-তেজগাঁও-কমলাপুর-নারায়ণগঞ্জ এই রেল করিডোরে কমিউটার সার্ভিস চালু করে বিশালসংখ্যক যাত্রী পরিবহনের ব্যবস্থা করা - ঢাকার আশেপাশে আঞ্চলিক যোগাযোগ বাড়ানোর জন্য যোগাযোগ অবকাঠামো হিসেবে ব্যয়সাশ্রয়ী লাইট র‍্যাপিড ট্রানজিট (এলআরটি)কে বিবেচনায় নিয়ে পরিকল্পনা গ্রহণ - বর্তমান অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জ এবং ঢাকার পরিবেশগত দূর্যোগপূর্ণ অবস্থা বিবেচনায় নিয়ে যোগাযোগ সংশ্লিষ্ট মেগা প্রজেক্ট বাস্তবায়নে ‘ধীরে চলো নীতি’ অনুসরণ ও বিবেচনাপ্রসূত সিদ্ধান্ত গ্রহণ। - যোগাযোগ সংশ্লিষ্ট বৃহৎ অবকাঠামো প্রকল্প নেবার পূর্বে পেশাজীবি, অংশীজন ও সাধারণ জনগণ এর মতামত নেয়া - মেট্রোরেল নির্মাণ সহ যেকোন ধরনের যোগাযোগ অবকাঠামো নির্মাণে ঢাকার পরিবেশগত প্রভাব, জনভোগান্তি, ঢাকার ভারবহন ক্ষমতা, নির্মাণ কাজের জনস্বাস্থ্যগত প্রভাব এবং সার্বিক অর্থনৈতিক, পরিবেশগত ও পরিকল্পনাগত উপযোগিতার নির্মোহ বিশ্লেষণের মাধ্যমে প্রকল্প নির্ধারণ করা।   আইপিডি অনুষ্ঠানে আরও বক্তব্য রাখেন মোঃ মিজানুর রহমান, ডেপুটি আরবান প্ল্যানার, ঢাকা পরিবহন সমন্বয় কর্তৃপক্ষ, (ডিটিসিএ); পরিকল্পনাবিদ এটিএম শাহজাহান, সহকারী অধ্যাপক, চটগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়; মোঃ আসাদুজ্জামান, যোগাযোগ ও ভূমি ব্যবহার বিশেষজ্ঞ এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী সহ উত্তরা ও মিরপুর এলাকার নাগরিকগণ। পরিকল্পনাবিদ ড. আদিল মুহাম্মদ খান নির্বাহী পরিচালক ইনস্টিটিউট ফর প্ল্যানিং এন্ড ডেভেলপমেন্ট (আইপিডি)    

শেয়ার করুন

Author:

Etiam at libero iaculis, mollis justo non, blandit augue. Vestibulum sit amet sodales est, a lacinia ex. Suspendisse vel enim sagittis, volutpat sem eget, condimentum sem.

0 coment rios: